Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশের রফতানি খাত ও শ্রম ব্যবস্থার উন্নয়নে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০২২, ৪:৩১ পিএম

দেশের শিল্পায়ন, রফতানি খাত ও শ্রম ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কঠোর মনিটরিং করা প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন শিল্পখাতে বিদেশী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অব্যবস্থাপনা দূর করা দরকার। এটা করতে না পারলে বিভিন্ন প্রকল্পে থাকা এ দেশের শ্রমিকরা বিপাকে পড়বে। যদিও ইতোমধ্যে অনেকেই বিপাকে আছেন। ফলে সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আর্থিকখাত, শ্রম অধিকার ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় প্রকল্পগুলোতে বিদেশী কোম্পানীরগুলোর অদক্ষতা ও শ্রম অব্যবস্থাপনার কারণেই দেশীয় শ্রমিকরা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ক্ষতিগস্থ হচ্ছে। এমনকি শ্রম অব্যবস্থাপনার ঘাটতি গুলোর সমাধানেও ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানীগুলো। এখানে উল্লেখ্য, বিগত এক যুগ ধরে দেশের বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্পে ভারত, চীন ও জাপান বিনিয়োগ করে আসছে। এ সকল মেগা প্রকল্পের ইতোমধ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বিভিন্ন দেশের কোম্পানীগুলো। এছাড়া দেশের কোম্পানিগুলো শ্রম শোষণ ও অধিকার বঞ্চিত করছে শ্রমিকদের, যাদের কার্ষকলাপে অনেকক্ষেত্রে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শ্রমিকরা। বিদেশী কোম্পানীগুলোর দেয়া সব সাহায্য-সহযোগিতা এ দেশের শ্রমিকরা সঠিকভাবে পাচ্ছে না । করোনার সময় দেশের অনেক গার্মেন্ট শ্রমিকের চাকরি চলে গেছে। ওই সময়ে চাকরি যাওয়া অনেক শ্রমিক তাদের পাওনা নিতে পারেননি। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়েনের অর্থ সাহায্য্যে ১৫শ’ কোটি টাকা প্রণোদনো প্যাকেজে মাত্র ৯ কোটি টাকা ছাড় করেছে। অর্থাৎ দেশের গার্মেন্ট মালিকার শ্রমিকদের চাকুরি চলে যাবার জন্য ছাড় পত্র দিতে চায় না। শ্রম সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, আমারা বার বার মালিকদের ডেকে বলেছি তারা যাতে চাকুরি যাওয়া শ্রমিকদের ছাড় পত্র দেয়। কিন্তু এ অবস্থার কোন উন্নতি হচ্ছে না। তবে আশা করছি, সব পক্ষকে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আশা করি প্রনোদনা তহবিলের খরচের পরিমান বাড়বে।

তিনি বলেন, শ্রমিকরা যাতে তার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায় সে ব্যাপারে শ্রম মন্ত্রণালয়ে প্রতিটা সংস্থা সজাগ আছে। এ ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি কোন কোম্পানিকেই আমরা ছাড় দিবো না।

কয়েক বছর আগে বাঁশখালী পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পে শ্রম অব্যবস্থাপনা, শ্রমিক শোষণ ও বৈষম্যের বিস্তর অভিযোগ উঠেছিল। বেসরকারি খাতের এই প্রকল্পে ২০১৬ সাল থেকে তিনটি পৃথক ঘটনায় ১২ জন শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দা নিহত হয়েছেন। দেশীয় শ্রমিক ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যকার বেতন বৈষম্য এবং বাংলাদেশী শ্রমিকদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করার কারণে সৃষ্ট ঘটনা থেকেই এসব নিহতের ঘটনা ঘটে।

সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল। এদিন নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন অনিয়ম বন্ধে দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি চালায়। এ সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের পক্ষ নেয় পুলিশ। নির্মাণাধীন এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াাট ক্ষমতার এই কেন্দ্রে পাঁচজন শ্রমিক নিহত হয়। শ্রমিকরা শুধু বকেয়া বেতন চেয়েছিল। একইসঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি এবং শুক্রবার অর্ধেক দিন কাজ করার দাবি করেছিল। কিন্তু তাদের সে দাবির সুষ্ঠু ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো স্থানীয় শ্রমিকদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এসব ঘটনায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পাশাপাশি প্রকল্পে কর্মরত চীনা কর্মকর্তা-শ্রমিকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকদের অভিযোগ, ওই সময় শুক্রবার জুম্মার নামাজের জন্য ছুটি চাইলেও দায়িত্বরতরা শ্রমিকদের ছুটি দিতে অস্বীকার করেছিল। তারপরেও কেউই ধর্মীয় উপাসনার জন্য কর্মস্থল ত্যাগ করলে তাদের মজুরি কাটা হতো। ওই প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়ন করে চীনের সেপকো-এলএলএল ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন এবং এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ এবং চট্রগ্রামভিত্তিক দেশীয় বড় একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের দুই দশমিক চার বিলিয়ান ডলার বিনিয়োগের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একটি অব্যবস্থাপনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাঁশখালীর শ্রমিক নেতা তপন দে এ প্রসঙ্গে বলেন, সেপকো এলএলএল ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ পাওয়ার প্লান্টে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করছে না। এমনকি, তারা জুম্মার নামাজের জন্য বিরতি চাওয়া শ্রমিকদের অপমান করে। মজুরি দেয়া হয় অনিয়মিতভাবে। পাওয়ার স্টেশনে কাজের পরিবেশ খুবই খারাপ।

জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে লবণ চাষ, চিংড়িং চাষ ও মাছ ধরারকার্যক্রমে স্থায়ীভাবে লোকসান বা জীবিকা হ্রাস পাবে। পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রশাসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রকল্পটি শেষ হওয়ার পরে এক হাজার লোককে স্থায়ী চাকরির সুযোগ দেয়া হবে। বাস্তবে তা হচ্ছে না। এছাড়া, ২০২১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার অদূরে নারায়াণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুসের কারখানায় একটি ছয়তলা জুস কারখানায় ভয়াাবহ অগ্নিকান্ডে কমপক্ষে ৫২ জন নিহত এবং ৫০ জনের বেশি আহত হয়। যা বিদেশী নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত অবৈধ কারখানার অস্তিত্ব সামনে নিয়ে আসে। এদিকে, গত আট বছরে বাংলাদেশে রহস্যজনকভাবে সরকারের অগোচরে অবৈধভাবে একটি বিদেশী কোম্পানি ব্যাটারি তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে পান্না গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক হাতেম আলী ভূঁইয়া বলেন, বিদেশী নাগরিকরা ভিজিটর ভিসায় বাংলাদেশে এসেছে এবং কোনো অনুমতি ছাড়াই ছোট ব্যাটারি কারখানা খুলেছে। এসব কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করছে এবং স্থানীয় ব্যাটারি উৎপাদকদের ব্যবসা হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।

অ্যাকুমুলেটর বাংলাদেশ ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুনাওয়ার মিসবাহ মঈনের মতে, নারায়ণগঞ্জের বিদেশীরা বাইশটি কোম্পানী তৈরি করে অবৈধভাবে ব্যাটারি উৎপাদন করছে। তিনি বলেন, দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এই অবস্থায় কারখানাগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের যোগসাজশে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদেশী নাগরিকদের দ্বারা স্থাপিত অবৈধ কারখানাগুলির বিরুদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদফতরে অভিযোগ দায়ের করেছি। মুনাওয়ার মিসবাহ মঈনের বলেন, স্থানীয় ব্যাটারি নির্মাতারাও সম্প্রতি এই বিষয়ে বিভিন্ন দূতাবাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন সংস্থা আছে, সেই সংস্থাগুলোকে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আশা করি দেশের ব্যাটারি নির্মাতারা এ দূরাবস্থা থেকে উঠে আসবে ।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কঠোর পদক্ষেপ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ