পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্কুলের নোট ও গাইড বই প্রকাশ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও সর্বত্রই তা দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। একশ্রেণীর প্রকাশক ও শিক্ষক এই অবৈধ ব্যবসা থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা বারবার বলছেন, নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের অন্তরায় হয়ে রয়েছে। তারা সৃষ্টিশীল পড়ালেখা থেকে দূরে সরে গিয়ে মুখস্ত বিদ্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে সরকারের শিক্ষানীতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ১৯৮০ সালে নোটবই নিষিদ্ধকরণ আইনে নোট ও গাইড বই ছাপা ও বাজারজাত করা পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ এবং ২০০৯ সালে আপিল বিভাগ গাইড ও নোট বই নিষিদ্ধ করে নির্দেশনা প্রদান করে। এ নির্দেশনায় নোট ও গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় এসব বই নির্বাধে প্রকাশ ও বিক্রি হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বই অনুসরণ করার জন্য একশ্রেণীর শিক্ষক উৎসাহ দিচ্ছে। এ শ্রেণীর শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রকাশকদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। ঘুষের বিনিময়ে তারা শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বই অনুশীলন করতে পরামর্শ দিচ্ছে। শিক্ষকদের ঘুষ প্রদানের বিষয়টি গত বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ৫৫টি প্রকাশনী শিক্ষকদের একটি অংশকে ঘুষ প্রদান করে নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের কাছে ‘পুশ সেল’ করার জন্য নিয়োজিত করেছে। সুনির্দিষ্ট এ অভিযোগ ও তথ্য দেয়ার পরও এসব বইয়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বইগুলোর বিরুদ্ধে জাতীয় পাঠপুস্তক কারিকুলাম বোর্ডের সাঁড়াশি অভিযান চালানোর দায়িত্ব হলেও তা তারা মোটেও পালন করছে না। গত দেড় বছরে বোর্ড একটি অভিযানও পরিচালনা করেনি।
নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ ও ভিত্তি গঠনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ অন্তরায় হয়ে রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যার দিকে ধাবিত করে তা তাদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব বইয়ে তাদের মেধা বিকাশের কোনো উপাদান থাকে না। উল্টো অনেক কিছু ভুল শেখে, যা থেকে শিক্ষার্থীরা কখনো বের হয়ে আসতে পারে না। মেধা খাটিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রশ্নের উত্তর ও অন্যান্য বিষয় জানতে চেষ্টা করার মধ্যে শিক্ষার্থীকে যে চিন্তা ও মাথা ঘামাতে হয়, তাতে তাদের মেধা বিকাশের পথ খুলে যায়। ভুলভ্রান্তিতে ভরা নোট ও গাইড বইয়ে সব কিছু থরে থরে সাজানো থাকায় শিক্ষার্থীরা কষ্ট করতে চায় না। মুখস্ত করতে শুরু করে। এতে তাদের সৃজনশীলতার কোনোই চর্চা হয় না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, একশ্রেণীর শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের মনন ও সৃজনশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। তারা নিজেরা ক্লাসে সঠিকভাবে পড়াশোনা না করিয়ে প্রকাশকদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের নোট ও গাইড বই কেনার পরামর্শ দেন। এমনকি প্রাইভেট পড়ানোর ক্ষেত্রেও নোট ও গাইড বইয়ের আশ্রয় নেন। মূল বই থেকে শিক্ষার্থীদের অনেক দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জনের যে লক্ষ্য তা কোনোভাবেই অর্জিত হয় না। এমনকি পাঠ্যপুস্তকের পুঁথিগত যে বিদ্যাটুকু আহরণের প্রয়োজন, তা থেকেও তারা বঞ্চিত হয়। তারা কিছু সিলেক্টিভ প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করার মাধ্যমে সংকীর্ণ মুখস্ত বিদ্যাধারীতে পরিণত হচ্ছে। এসব নোট ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের পথটিকে ইঁদুরের মতো কেটে খেয়ে ফেলছে। সরকার যে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছে, তাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে চলেছে। আবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে অনেক শিক্ষক অভিজ্ঞ না হওয়ায় তারাও নোট ও গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এ অভিযোগ বহুকাল ধরেই রয়েছে শিক্ষকরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের চেয়ে প্রাইভেট কোচিংয়ে বেশি আগ্রহী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে বাধ্য করা হয়। যদি তাই হয়, তবে স্কুলের ক্লাসের প্রয়োজনীয়তা কী। সব ক্লাস কোচিং বা প্রাইভেটে পরিণত করলেই তো হয়। এমন বিতর্ক ওঠার পরও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। বলা বাহুল্য, সন্তানকে আলাদা আলাদা বিষয়ে অলিখিত বাধ্যতামূলক কোচিং করাতে গিয়ে অভিভাবকদের নিদারুণ অর্থকষ্ট ও টানাপড়েনে পড়তে হচ্ছে। সন্তানের সুশিক্ষার দিকে তাকিয়ে সব কষ্ট তারা মেনে নিচ্ছেন। এ থেকে যেন পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। এসব অনৈতিক কর্মকা-ের পাশাপাশি নোট ও গাইড বইয়ের দিকে শিক্ষার্থীদের উৎসাহী করে তোলা হচ্ছে। এসব দেখভালের দায়িত্ব জাতীয় কারিকুলাম পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের হলেও এ ব্যাপারে বোর্ড চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলেছে। এর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানোর কথা থাকলেও লোকবল অভাবের অজুহাতে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। এ সুযোগে নোট ও গাইড বই প্রকাশকরা রমরমা ব্যবসা করে চলেছে।
আইন করে নিষিদ্ধ করা এবং আপিল বিভাগের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাজারে অবৈধ নোট ও গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি সুস্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন। এর দায় জাতীয় কারিকুলাম পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না। যে নোট ও গাইড বই পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যাহত করে মেধাহীন একটি প্রজন্ম সৃষ্টিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে, তা কেন বন্ধ হবে না বা করা হচ্ছে না এবং এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না, এর সঠিক কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সরকারের শিক্ষানীতি একশ্রেণীর প্রকাশক ও শিক্ষক ব্যাহত করে চলবে, এর প্রতিকার পাওয়া যাবে না, এটা কেমন কথা! আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে থাকা নোট ও গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বোর্ড ও মন্ত্রণালয়কে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অবিলম্বে এসব মেধাক্ষয়কারী পুস্তকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। অবৈধ নোট ও গাইড বইয়ের প্রকাশ ও বিকাশের সাথে যারাই জড়িত থাকুক না কেন কোনো অবস্থাতেই তাদের ছাড় দেয়া যাবে না। আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।