Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল কারেন্সির ব্যবহার ও সম্ভাবনা

সাজ্জাদ হোসেন রিজু | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

২০২২-২৩ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী দেশে ডিজিটাল মুদ্রা চালুর বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। বহুপাক্ষিক বিশেষঞ্জদের নিয়ে এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজটি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জেনে নেওয়া যাক, ডিজিটাল মুদ্রা সম্পর্কে।

ডিজিটাল মুদ্রা বা প্রচলিত ক্রিপ্টোকারেন্সির কথা হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। সহজ কথায় যে মুদ্রা ডিজিটাল পদ্ধতিতে ইস্যুকৃত, সংরক্ষিত এবং লেনদেনও হয়ে থাকে ডিজিটাল প্লাটফরমে এমন মুদ্রাই হলো ডিজিটাল মুদ্রা। ডিজিটাল মুদ্রাকে ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে ডাকা হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে ডাকার কারণ হলো, এই মুদ্রা একজন ব্যবহারকারির আইডির সাথে এনক্রিপ্টেড অর্থাৎ সংযুক্ত। ব্যবহারকারী নিজের ক্রিপ্টোকারেন্সি আইডিতে লগইন করা মানেই নিজের ক্রিপ্টোকারেন্সির সংরক্ষণ ও লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ ব্যবহারকারী নিজেই এর নিয়ন্ত্রণকারী। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, এটাই ক্রিপ্টোকারেন্সির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এটিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে আইনগত বৈধতা দেয়নি। এরপরও গোপনে এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক লেনদেনকে ব্যপকভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্য থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (ঈবহঃৎধষ ইধহশ উরমরঃধষ ঈঁৎৎবহপু-ঈইউঈ) ধারণার উদ্ভব।

কী এই সিবিডিসি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা বা সিবিডিসি নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফলে ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো এটি কোনো অবিভাবকহীন মুদ্রা হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটালি এই মুদ্রা ইস্যু করবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে। এখন যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাগজের মুদ্রা ইস্যু করে ঠিক তেমনই সিবিডিসি ইস্যু করবে, যার শুরুটাই হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। বর্তমানে কাগজের মুদ্রাকে আমরা ডিজিটাল প্লাটফরমের মাধ্যমে (ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস, ব্যাংকিং এপ্লিকেশন) সংরক্ষণ ও লেনদেন করতে পারি কিন্তু সিবিডিসি নিজেই ডিজিটাল হয়ে অর্থবাজারে প্রবেশ করবে। এতে করে, ডিজিটাল রূপ পাওয়ার জন্য ব্যবহারকারীকে এখনকার মতো এজেন্টের কাছে গিয়ে নগদ টাকা দিয়ে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে ক্যাশ ইন বা কার্ডে লিমিট নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।

সিবিডিসির ব্যবহার: শুরুতেই বলে রাখা ভালো, সিবিডিসি আসার ফলে কাগজের মুদ্রা বাজার থেকে উঠে যাবেনা। এই দুই মুদ্রার মান এই থাকবে এবং তা পাশাপাশি ব্যবহৃত হতে থাকবে। যে কেউ চাইলেই সিবিডিসিকে ভাঙিয়ে কাগজের মুদ্রা বা কাগজের মুদ্রাকে সিবিডিসিতে রূপান্তর করতে পারবে। মূলত ভার্চুয়াল লেনদেন ও ই-কমার্সের প্রসারের লক্ষ্যেই সিবিডিসি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। প্রচলিত ডিজিটাল প্লাটফরম যেমন প্লাস্টিক মানি, মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এগুলোর মাধ্যমে দেশের মধ্যে লেনদেন করা গেলেও বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতিক ই-কমার্স লেনদেন করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় যদি প্রতিটি দেশের নিজস্ব সিবিডিসি থাকে এবং তা নিজ নিজ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিংয়ের আওতায় থাকে, তবে মুহূর্তেই একদেশ থেকে আরেক দেশে নিরাপদে ও সহজে পেমেন্ট করা সম্ভব হবে। আর এই পেমেন্ট করার কাজটি ব্যবহারকারী নিজেই করবেন। ফলে সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হবে।

বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের সহজীকরণ: উপরের আলোচনা থেকেই পরিষ্কার যে, সিবিডিসি ব্যবহারকারী দেশেসমূহের মধ্যে মুহূর্তেই লেনদেন করা সম্ভব হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মুদ্রা বিনিময়ের পদ্ধতি কীভাবে হবে? আমরা জানি, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারকেই ভিত্তি মুদ্রা হিসেবে ধরা হয়। সিবিডিসি কাজ করবে ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার সিস্টেমে এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে ব্যবহারকারী সকল দেশ একটি কমন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত থাকবে। প্রত্যেক গ্রাহক হবে এই নেটওয়ার্কের সর্বশেষ স্তর। গ্রাহক পর্যায় থেকে তার নিজস্ব লোকাল সিবিডিসির পরিমাণ লেনদেন সম্পন্ন হবে। মুদ্রা বিনিময়ের কাজটি করবে নেটওয়ার্ক হেডকোয়ার্টার। যেমন ধরুন, আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো এক ই-কমার্স সাইট থেকে ১ ডলার সিবিডিসি মূল্যের কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় করতে চাইলে আপনাকে আজকের বিনিময় মূল্য অনুযায়ী ঐ পণ্যের মূল্য ৯০ টাকা সিবিডিসি (ধরি, আজকের রেট ১ ডলার সমান ৯০ টাকা) পরিশোধ করতে হবে। আপনি ভারতীয় হলে এই মূল্য ভারতীয় রুপি সিবিডিসি অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে। অনুরূপভাবে আপনি কোনো পণ্য বা সেবা বহির্বিশ্বে বিক্রি করলে আপনি টাকা সিবিডিসিতে মূল্য বুঝে পাবেন আর ক্রেতা ডলার সিবিডিসি বা রুপি সিবিডিসিতে পরিশোধ করবে। আর নিজ ভূখন্ডের মধ্যে এটি সাধারণ মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মতোই কাজ করবে।

সিবিডিসির নিরাপত্তা: সিবিডিসি সম্পূর্ণ ডিজিটাল একটি মুদ্রা হওয়ায় এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও হবে ডিজিটাল। তবে এর ব্যবহারকারীকে যথেষ্ট প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। আমাদের দেশে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের ব্যবহার ১২ বছর ধরে চলছে, অথচ ব্যবহারকারীরা এখন পর্যন্ত তাদের আইডি, পাসওয়ার্ড, ওটিপিসহ তথ্যসুরক্ষায় সচেতন নয়। শুধুমাত্র অর্থ স্থানান্তর ছাড়া তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা পৌঁছে দেওয়া এখনও সম্ভব হয়নি। ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীর নিজের সচেতনতার ঘাটতি একটি বড় বাধা। তবে সিস্টেম সুরক্ষা, তথ্য নিরাপত্তা আর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো গেলে সিবিডিসির ব্যবহার হয়ে উঠতে পারে অধিকতর নিরাপদ।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি: আইএমএফ-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশ সিবিডিসি চালু করার পরিকল্পনা করছে এবং ইতোমধ্যে তারা পাইলট প্রকল্প শেষ করেছে। আটলান্টিক মহাসাগরের অন্তর্গত দীপপুঞ্জ দেশ বাহামা ২০২০ সালের অক্টোবরে সর্বপ্রথন ‘স্যান্ড ডলার’ নামে ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করেছে। ২০২০ সালে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে নাইজেরিয়া ‘ই-নায়ার’ নামে ডিজিটাল মুদ্রা ইস্যু করে, যা ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৭ লক্ষ ডাউনলোড হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র জ্যামাইকা শিগগিরই তাদের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালু করতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, সুইডেন ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্প সম্পন্ন করেছে।

সিবিডিসির ব্যবস্থাপনা সুবিধা: পুরোপুরি ডিজিটাল মুদ্রা হওয়ার কারণে কাগজী মুদ্রার মতো এর ছাপানো ও পরিবহন খরচ নেই। প্রচলন অযোগ্য টাকার জন্য যে বিপুল পরিমাণ ব্যয় হয় সেই খরচটিও সিবিডিসির ক্ষেত্রে শূন্য। ডিজিটাল ব্যবস্থা হওয়ায় ব্যবহারকারী পর্যায়েও এর রক্ষণাবেক্ষণ ও লেনদেন খরচ তুলনামূলক কম হবে। তবে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে সিবিডিসির প্রতি গুরুত্বারোপ বাড়বে।

বাংলাদেশে সিবিডিসির সম্ভাবনা: প্রায় ১২ বছর ধরে এদেশে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস কাজ করছে। আশানুরূপ না হলেও দিনদিন ডিজিটাল লেনদেনের মাত্রা বাড়ছে। সুতরাং ডিজিটাল লেনদেনের বিষয়টি বাংলাদেশ একেবারে নতুন কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশে প্রচুর আইটি ফ্রিল্যান্সারেরা রয়েছে, যাদের পেমেন্ট আসে বৈদেশিক মুদ্রায়। অনেক বাংলাদেশি এখন দেশে বসে বিদেশে টিউশনি করে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে এমনকি অফিসও করে। সিবিডিসি তাদের জন্য আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অনেক সহজ করে আনবে। আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রেও সিবিডিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সর্বোপরি, বিশ্ব আধুনিক প্রযুক্তিকে স্বাগত জানালে আমাদের চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই। তাই, সিবিডিসিকে গ্রহণ করতে হবে। সেটা আজ হোক অথবা কাল।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড এবং ফেলো, বাংলাদেশ স্কুল অফ ইন্টারনেট গভর্নেন্স।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল কারেন্সির ব্যবহার ও সম্ভাবনা
আরও পড়ুন