Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দুর্নীতি-লুটপাট, আইনের শাসন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সঙ্কট

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গত একযুগ ধরে হাইব্রিড রিজিমে আটকে আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীনরা দলীয়করণ করে জনগণের ভোটাধিকার কুক্ষিগত করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখন একটি একদলীয় কর্তৃত্ববাদী রিজিম চরিত্র ধারণ করেছে। এ ধরণের শাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সরকারের সমালোচনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও নজরদারির মাধ্যমে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মাধ্যমে জনগণের ক্ষোভ ও অসন্তোষকে ধামাচাপা রেখে সরকারের কথিত উন্নয়ন এবং সুনির্দিষ্ট দলীয় রাজনৈতিক ভাবধারার জয়গান ব্যাপক আয়োজনে প্রচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা মেইনস্ট্রীম মিডিয়াগুলোর বিশ্লেষকরা দৃষ্টান্ত হিসেবে উত্তর কোরিয়া বা ইরানকে সামনে নিয়ে আসলেও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ভ’-রাজনৈতিক স্বার্থহানির আশঙ্কায় বশংবদ রাজতান্ত্রিক বা সামরিক শাসকদের নাম ঠিক সেভাবে উঠে আসেনা। আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার, পাকিস্তান- বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক আগে থেকেই। এমনকি আমাদের দেশের একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতারাও পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ধারাবাহিক ঘটনাবলী নিয়ে বেশ সমালোচনা মুখর থাকেন। কিন্ত সামরিক কিংবা জনগণের রাজনৈতিক চাপে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হওয়ার ঘটনা এবং সব রাজনৈতিক শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং নির্বাচনব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক পন্থায় কুক্ষিগত করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়টি জনগণের কাছে অনেক বেশি অনাকাঙ্খিত ও ঘৃণিত বিষয়। এশিয়ার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাপানের একটি উজ্জ্বল ভাবমর্যাদা তৈরী হলেও গত কয়েক দশকের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে জাপানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। বিরোধি পক্ষ বা দলের অভ্যন্তরে সামান্য বিতর্ক বা সমালোচনার সম্মুখীন হলেই জাপানি ক্যাবিনেট মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে দেখা যায়। এ কারণে সেখানকার জনগণকে রাজনৈতিক দাবি নিয়ে কখনো উত্তেজনা, আন্দোলন সংগ্রামের মত বিষয়ে শক্তি ক্ষরণ করতে হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন পারমানবিক অস্ত্রের টার্গেট হয়ে পরাজিত হওয়ার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যে জাপান বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার পেছনে তাদের জনগণের কঠোর পরিশ্রম, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি- প্রগতি ও আইনের শাসনের প্রতি সব নাগরিকের কমিটমেন্ট সবচেয়ে বড় ভ’মিকা রেখেছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্তে¡ও জাপান থেকে অর্থপাচারের অঙ্ক বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।

করোনা লকডাউনে স্বাস্থ্য নির্দেশনা ভঙ্গ করায় গত এপ্রিলে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পুলিশের জরিমানার সম্মুখীন হয়েছিলেন। জরিমানা দিয়ে তিনি পার্লামেন্টে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে গত সোমবার(৬জুন) গার্ডিয়ানের অনলাইনে প্রকাশিত খবরে বৃটিশ পার্লামেন্টে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। পার্লামেন্টের অনাস্থা ভোটে হেরে গেলে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার আশঙ্কা ছিল বরিস জনসনের। মাত্র তিন বছর আগে বৃটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভ’মিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি। আমরা বৃটিশ আদলের বহুদলীয় গণতন্ত্রের দাবি করি। আমাদের সংবিধানকে সেভাবেই পূনর্বিন্যাস্ত করা হয়েছে। আমরা জনগণের রাজনৈতিক অধিকার ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও প্রত্যয় নিয়ে ১৯৭১ সালে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রে শাসকদের প্রবঞ্চনায় যখন গণতন্ত্রের পথ আবারো রুদ্ধ হয়েছে তখনি ভয়ঙ্কর, অমানবিক-মর্মন্তুদ বিয়োগান্তক পটপরিবর্তন ঘটেছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আবারো সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলতে হয়েছে। সেই জাতিয় ঐক্যের মঞ্চ থেকেই নিপেক্ষ প্রশাসনের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফর্মুলা হিসেবে নির্বাচনকালীন সময়ে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের রূপরেখা গ্রহণ করা হয়। সেই রূপরেখার অধীনে অনুষ্ঠিত ৩টি জাতীয় নির্বাচনের কোনোটিতেই কোনো সরকার দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায় আসতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে প্রমানিত হয়েছে, এ দেশে সত্যিকারের জনমত ৫ বছরের বেশি কোনো দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায়না। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারি দল ও বিরোধিদলের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই জনগণের প্রত্যাশা, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য বিকশিত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার সবর্ণ জয়ন্তির সময়ে এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অর্জনগুলো যখন বিশ্বের সামনে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হওয়ার কথা তখন আমাদেরকে হাইব্রিড রিজিমের তকমা বহন করতে হচ্ছে। আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা চরমভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রশ্নে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর নেপথ্যে যা কিছুই থাক না কেন। আমরা হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও নির্বাচনব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশের প্রহসনমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা, হয়রানিমূলক মামলায় প্রধান বিরোধিদলের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে নিস্ক্রিয় করে রেখে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ডায়ন্যামিক্সকে অকার্যকর করে ফেলার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে তা’ আমাদের রাষ্ট্রকে দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর করে তুলেছে। একটি বিভক্ত ও ভারসাম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত সব সময়ই দুর্বল ও অনিশ্চিত।

গত দেড় দশকে দেশ থেকে অন্তত ১০ লক্ষকোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। কারা এসব টাকা পাচার করে কানাডা, আমেরিকা, সুইসব্যাংকসহ ইউরোপের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছে তার খন্ডচিত্র ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং তথ্য সংগ্রহের আন্তর্জাতিক সংস্থা পানামা পের্পাসেও বাংলাদেশের বেশ কিছু নাম উঠে এসেছে। আর গত এক দশকে দেশে শেয়ার বাজার, ব্যাংকিং সেক্টর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নানাভাবে জালজালিয়াতি ও পারস্পরিক যোগসাজশে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নাম এখন আর কারো অজানা নেই। তবে সে সব দুর্নীতির নেপথ্যের অনুঘটকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির সাথে জড়িত কথিত মূল হোঁতারাও এখনো পর্দার অন্তরালে বহাল তবিয়তে আছেন। পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে গিয়ে গ্রেফতার হলেও এসকে সুর চৌধুরি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর আতিউর রহমান বা আইটি কনসালটেন্ট রাকেশ আস্তানাকে এখনো তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়নি। ৬ বছর আগে ২০১৬ সালে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পানামার কর্পোরেট সেবা প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে বিগত ৪ দশক ধরে বিভিন্ন দেশ থেকে মিথ্যা ডকুমেন্টে বিদেশে টাকা পাচারের সাথে জড়িত হাজার হাজার ব্যক্তির এক কোটির বেশি নথি থেকে সামান্য অংশ প্রকাশ করে। সেই তালিকায় চীন, রাশিয়াসহ বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তানের শত শত নাম উঠে আসে। লাখ লাখ নথি থেকে প্রকাশিত তালিকায় রাজনৈতিক বা গোষ্ঠিগত স্বার্থ বিবেচনা থাকা অস্বাভাবিক নয়। কোনো নির্দোষ সাধারণ ব্যক্তির নাম সেই তালিকায় এসেছে, এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি বা কেউ দাবিও করেনি। তবে পানামা পেপার্স প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে বেশকিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে। গণবিক্ষোভের মুখে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। গণমাধ্যমে পানানা পেপার্স ফাঁস হওয়ার পর বিগত শতকের ৯০ দশকে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাঁচারের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তানের আদালত নেওয়াজ শরিফকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছিল। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, পাকিস্তানের আদালত সে দেশের সরকার প্রধানকেও বরখাস্তের নির্দেশ দিতে পারে এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ক্ষমতাসীনদের চাপে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি সরকারের পক্ষে দেয়ার জন্য তার উপর সরকারের চাপ সত্তে¡ও তিনি তা অনুসরণ না করায় তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অত:পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেয়া হয়। দেশের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দিয়ে বিবাদির অনুপস্থিতিতের স্বল্প সময়ের মধ্যে কারাদন্ডের রায় দেয়া সম্ভব হলে। কিন্তু এক দশকেও বেসিক ব্যাংক বা বিসমিল্লাহ্ গ্রæপের হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির বিচার শেষ করে রাষ্ট্রের অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারেনি সরকার। সবই যেন সরকার ও প্রশাসনের ইচ্ছাধীন বিষয়।

পাকিস্তানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের পতনের পর ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এবং তার পুত্র পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হামজা শাজবাজকে গ্রেফতারের জন্য বিশেষ আদালতের বিচারকের কাছে অনুমোদন চেয়েছে সে দেশের ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির(এফআইএ) একজন কৌসুলি। ১৬ বিলিয়ন রুপীর দর্নীতির মামলায় ফেডারেল তদন্ত সংস্থা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতার করতে চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে। এ থেকে অনেক কিছুই প্রমানিত হয়। বরিস জনসনকে পুলিশ জরিমানা করেছে, শাহবাজ শরীফ ও তার পুত্রকে দুর্নীতির মামলায় তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করার অনুমোদন যাওয়ার মধ্য দিয়ে এসব দেশের পুলিশ এবং তদন্ত সংস্থা সরকারের প্রভাবমুক্ত আইনের শাসন নিশ্চিত করার স্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে সক্ষম হচ্ছে। মাঝে মধ্যে দু’একজন হোমড়া-চোমড়াকে আটক করার পর আমাদের সরকারের মন্ত্রী এমপিরা বুক ফুলিয়ে বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।স আইন সবার জন্যই সমান। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করার সাথে জড়িত, ব্যাংক জালিয়াতি ও শেয়ারবাজার লুটেরাদের দেখেও না দেখার ভান দেখে জর্জ অরওয়েলের সেই উক্তিটি মনে পড়ছে, ‘এমিমেলস আর ইকোয়াল, সাম এনিমেল্স আর মোর ইকোয়াল দ্যান আদার্স’। হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ব্যক্তিরা এখনো বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে বহাল তবিয়তে আছেন। তারাই আবার ১০-২০ হাজার টাকা কৃষি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ঋনখেলাপি কৃষকদের কোমরে দড়ি দিয়ে বেধে আদালতে হাজির করতে পিছপা হননা। তবে সোমবার(৬জুন) পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, গত তিন মাসে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০, ১৬৭ কোটি টাকা। একইদিনে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদে জানা যায়, ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কতিপয় ধারা সংশোধন করে এখন ঋণ খেলাপিদেরও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিতে যাচ্ছে সরকার। এসব ঋণ খেলাপিদেরকে নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনের শাসন, দুর্নীতি-লুটপাট ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে কি ধরণের উন্নয়ন ঘটবে তা দেখতে আমাদের হয়তো আগামী সরকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতি যে একটা বড় খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।

আমাদের দেশের অনেকেই পাকিস্তানের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলেন। মাথাপিছু আয় এবং শিক্ষার হারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা এখন এক দেউলিয়া অর্থনীতির বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে। শ্রীলঙ্কান শাসক পরিবারের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বন্দুকের নল দিয়ে দমনের চেষ্টা করেনি। এখানে বাংলাদেশ সম্ভবত একধাপ এগিয়ে আছে। গত একযুগে তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সারাবিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় চরম বৈষম্য ও অনিশ্চয়তা ভর করেছে। দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই। রেমিটেন্সে ভাটার টান। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকারত্বের হতাশা নিয়ে দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে বেড়ে চলেছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট ও টাকা পাচারের প্রবণতা। ডলারের বিপরীতে বার বার টাকার অবমূল্যায়ণ এবং খোলা বাজারে অব্যাহতভাবে মূল্যবৃদ্ধি থেকে বুঝা যাচ্ছে, এক শ্রেণীর মানুষ বেশি দামে ডলার কিনে বিদেশে পাচার করায় লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক লুণ্ঠন প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং আইনের শাসনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে না পারলে জাতি হিসাবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একটি ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে লুটপাট দুর্নীতি, অপশাসন ও মানবাধিকার হরণের এই মচ্ছব থেকে জাতির মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।


[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন