পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পদ্মাসেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। ১৯৯৮ সালে এ সেতুর প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মাসেতু নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর রাজনৈতিক পট ও সরকার পরিবর্তনের কারণে থেমে যায় পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ। চারদলীয় জোট সরকারের সময় এ সেতু নির্মাণে তেমন কোনো কাজ হয়নি। তবে জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়। সেনাশাসিত ফখরুদ্দীন সরকারের সময় ২০০৭ সালে একনেকে পদ্মাসেতু প্রকল্প পাস হয়। তখন এ প্রকল্প ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এরপর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারও ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রস্তাব সংশোধন করতে হতে পারে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠনের পর আবারও পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়। চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু মাঝপথে থেমে যায় পদ্মাসেতুর কাজ। বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনেকের ধারণা ছিল, এ সরকারের পক্ষে আর এ সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দেন, পদ্মাসেতু নির্মাণ হবে নিজেদের টাকায়। যেমন কথা তেমন কাজ। তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন।
পদ্মাসেতুটি সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ সেতু যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। বিশেষত এটি ভুটান, ভারত এবং নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য ও পর্যটনের জন্য আরো দ্রুত সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করবে। পদ্মাসেতু পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে বার্ষিক জিডিপিতে এটি প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান রাখবে, দারিদ্র্য হ্রাস করবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াবে। এটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগের দরজা খুলে দেবে এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানতম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে ঢাকার যাতায়াত সময় ১০ শতাংশ হ্রাস পেলে অর্থনৈতিক আয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প মূল্যায়ন দলিল অনুসারে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে এবং এতে জাতীয় জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ।
পদ্মাসেতু ছাড়াও দেশে বর্তমানে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল (এইচএসআইএ) এবং যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্রিজসহ বেশ কয়েকটি মেগা অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে, সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে তফসিল অনুসারে চলমান এবং ভবিষ্যতের মেগা প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কিছু মহলের আশঙ্কা সত্ত্বেও উন্নয়নশীল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আরো মজবুত হবে।
আগামী জুন মাসের শেষের দিকে পদ্মাসেতু যানবাহন চলাচলে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কাজ চলছে। সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য চলছে ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ। এর মধ্যেই পদ্মাসেতু পারাপারের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। গত ২৮ এপ্রিল পদ্মাসেতুর জন্য টোলের হার প্রস্তাব করে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠায় সেতু মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অনুমোদনের পর তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়।
পদ্মাসেতু দিয়ে যানবাহন পারাপারে ফেরির চেয়ে দেড় গুণ টোল গুনতে হবে। এর ফলে যাতায়াতের সময় বাঁচলেও বেড়ে যাবে খরচ। টোল সাধ্যের মধ্যে আনার দাবি করেছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ। পদ্মাসেতুর টোলের হার নির্ধারণ করে সরকার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তাতে ফেরির চেয়ে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ টোল বেশি ধরা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মোটরসাইকেলের টোল ১০০, কার ও জিপের ৭৫০, পিকআপের ১ হাজার ২০০, মাইক্রোবাসের ১ হাজার ৩০০, ছোট বাস ৩১ আসন বা এর কম হলে ১ হাজার ৪০০, মাঝারি বাস ৩২ আসন বা এর বেশি হলে ২ হাজার এবং বড় বাস থ্রি এক্সেল ২ হাজার ৪০০ টাকা। ছোট ট্রাক ৫ টন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০, মাঝারি ট্রাক ৫ টনের অধিক থেকে ৮ টন পর্যন্ত ২ হাজার ১০০, বড় ট্রাক ৮ টনের অধিক থেকে ১১ টন পর্যন্ত ২ হাজার ৮০০, ট্রাক থ্রি এক্সেল পর্যন্ত ৫ হাজার ৫০০, ট্রেলার ফোর এক্সেল পর্যন্ত ৬ হাজার টাকা। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মাসেতু পারাপারে ফেরির চেয়ে টোল বৃদ্ধির সুযোগ নিচ্ছেন পরিবহন মালিকরা। ইতোমধ্যে বাস ভাড়া বৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু করেছে বাস কোম্পানিগুলো। বলা হচ্ছে, শুধু পদ্মাসেতু নয়, মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের জন্যও টোল দিতে হবে। ভাড়া বৃদ্ধির তোড়জোড়ে ইতোমধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে। তবে সরকারসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পদ্মাসেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ফেরির চেয়ে বেশি টোল আদায় করা হলেও যে জ্বালানি সাশ্রয় হবে তাতে ভাড়া বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতাই নেই। তারপর শুরু হবে সেতুতে রেললাইন স্থাপন। দুই বছরের মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত সরাসরি রেল চলাচল সম্ভব হবে। পদ্মাসেতুতে টোলের যে হার ধার্য করা হয়েছে তাতে ৩৫ বছরের মধ্যে খরচ উঠে আসবে। এ সেতু ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্বস্তি আনতে টোলের হার পুনর্বিবেচনা করা হবে, এমনটিই প্রত্যাশিত।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।