পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবেই তীক্ষè রাজনৈতিক চেতনা সম্পন্ন। সেই মুঘল আমল, বৃটিশ শাসন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ৫০ বছরসহ গত ৭শ’ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলার মুসলমানরা বিনাবাধায় শাসকবাহিনীকে ভয় পেয়ে আপস করেনি। কখনো কখনো নিরবতা অনেক বড় ঝড়ের লক্ষণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতিহাসে তার অনেক নজির রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে বাংলাদেশে তেমন কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা চোখে না পড়লেও একটি মহল দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা যখন সে দেশে নতুন কোনো মুসলিম বিদ্বেষী এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামতে শুরু করে তখন উপমহাদেশে ছড়িয়ে থাকা তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং বশংবদ সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠিগুলো একই সূত্রে বিভিন্ন তৎপরতা শুরু করে দেয়। গত দেড় দশক ধরে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আমাদের অতি সম্ভাবনাময় জাতীয় অর্থনীতিকে ভেতর থেকে ফোকলা করে দিয়েছে। করোনা পেন্ডেমিকে ভারত-পাকিস্তানের মত আঞ্চলিক সামরিক পরাশক্তি দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, তখনো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে অথবা দেখানো হয়েছে। তা নাহলে, হঠাৎ করেই দেশের অর্থনীতি এবং বৈদেশিক কারেন্সির রির্জাভ নিয়ে এতটা উদ্বিঘœ হওয়ার তেমন কোনো কারণ ছিলনা। চলতি অর্থবছরে দেশে আমদানি ব্যয়ের সাথে রফতানি আয়ের ঘাটতি আড়াই হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থবছরের শেষ দুইমাসে এই ঘাটতি আরো অন্তত ৫শ’ কোটি ডলার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ গত অর্থবছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ কমে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধসের প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিকে ঘিরে এমন একটি বৈরী সংকেত যখন বাতাসে ধ্বণিত হচ্ছে, তখন দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা পাচারের অন্যতম হোতা প্রশান্তকুমার হালদার ভারতে ধরা পড়েছে। তার অন্যতম সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিবেচিত এস কে সুরসহ অন্যদেরও ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের দাবি সমাজের ভেতর থেকে ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বেই নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজেদের জাতীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে কৃচ্ছতা ও মিতব্যয়িতার নীতি গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে দেশে টাকার অবমূল্যায়ন এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করার পরও খোলা বাজারে শত টাকায় ডলার বিক্রির চিত্র থেকে বুঝা যাচ্ছে, দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ হয়নি। হয়তো আগের চেয়েও অনেক বেড়ে গেছে। এ অবস্থা ঠেকাতে না পারলে আগামী দু’এক বছরে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কান সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
ভারতীয় কোনো কোনো মিডিয়ায় বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কান পরিস্থিতির আশঙ্কা খুব উচ্চস্বরে প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চেয়ে খুব ভাল অবস্থানে নেই কোনো কোনো ভারতীয় মিডিয়ায় সেটাও প্রচারিত হচ্ছে। ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিরূপ পরিস্থিতি প্রতিবেশি প্রায় সব দেশের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার কারণে ভারতের চলমান হিন্দুত্ববাদী শাসনের জেরে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক ভোটরাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এখনো দাঁত বসাতে না পারলেও দিল্লীতে হিন্দুত্ববাদীদের মসনদের প্রভাব সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে। কাশ্মিরে নজিরবিহীন হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস ভারতের অখÐতা ও গণতান্ত্রিক ইমেজের উপর কালিমা লেপন করেছে। চীন-মার্কিন-রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক রশি টানাটানির কারণে ভারতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবিদার ভারত সরকারের সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে তাদের কণ্ঠস্বর খুবই ক্ষীণ ও দুর্বল। ভারতে বিশ্বের প্রায় এক পঞ্চমাংশ মানুষের বসবাস। ভারত একইসঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠির দেশ। এই দেশে বড় ধরণের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ও সেই থেকে সৃষ্ট রক্তক্ষয়ী কোনো সংঘাত দেখা দিলে তা মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সেখানকার সংবিধানের গণতান্ত্রিক স্পিরিটকে অগ্রাহ্য করে মুসলমানদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করা, হত্যা করা এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করার মত ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। হিন্দুত্ববাদীদের এ অপচেষ্টা কোনো গোপণ বিষয় নয়, তারা সাধারণ হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে বহু বছর ধরে প্রকাশ্যেই মুসলিম বিদ্বেষী বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত একটি এথনিক ক্লিনজিং বা মুসলিম গণহত্যায় পরিনত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত শতকের দুইটি মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক দ্ব›দ্বই দায়ী। এরপর কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, গাল্ফওয়ার থেকে শুরু করে ইরান-ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রতিটি আঞ্চলিক ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ সংঘাত ও রক্তপাতের সাথে ইঙ্গ-মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তির প্রভাব স্পষ্ট। গত শতকের নব্বই দশকে পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় যে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল তার নেপথ্যেও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রচ্ছন্ন ভ’মিকা ছিল। তবে ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দ্বন্দের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৪ সালে হুতি ও তুতসিদের গণহত্যা শুরু হওয়ার দুই বছর আগেই জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্ট্যান্টন রুয়ান্ডায় এক ভয়াবহ গণহত্যার আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্ব সম্প্রদায় তার সেই আশঙ্কা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে রুয়ান্ডায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ এবং লাখ লাখ মানুষের সম্পদ ও বাস্তুভিটা রক্ষা পেত। রুয়ান্ডা গণহত্যার সিকি শতাব্দী পর সেই গ্রেগরি স্ট্যান্টন হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক চালচিত্র পর্যবেক্ষণ করে ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। গত বছরের শেষদিকে জেনোসাইড ওয়াচের পক্ষ থেকে গ্রেগরী স্ট্যান্টন এই আশঙ্কার কথা প্রকাশ করলেও গত ৬-৭ মাসে ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভারতের সিভিল সোসাইটি, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, সাম্যবাদে বিশ্বাসী মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক দলসহ কেউ এ বিষয়ে তেমন কথাবার্তা বলছে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুসলমানদেরকে একটি চরম প্রতিকুলতার মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বিজেপি শাসিত গুজরাটের পোরবন্দর এলাকায় মুসলমান জেলে পরিবারের ৬শ’ সদস্য একযোগে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানিয়েছে আদালতে। প্রশাসনিক অসহযোতিা, মাছধরা, নৌকা ও জাল রাখতে বাঁধা দেয়াসহ অস্তিত্বের সংকটে তিলে তিলে মৃত্যুবরণের চেয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুকেই বেছে নিতে চাইছে এসব অসহায় জেলে পরিবার। অন্যদিকে বিজেপি নেতারা তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডায় বিভিন্ন সময়ে মুসলমান গণহত্যার পরিকল্পনার কথা বলেছেন। তাদের কর্মীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিপক্ষের কর্মীদের হত্যা করে বিজয় নিশ্চিত করার কথা গণমাধ্যমেও এসেছে। ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যম এনডিটিভিতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, গত বছর হরিদ্বারে বিজেপি নেতাদের বৈঠকে হিন্দু রক্ষা সেনা নামের একটি সংগঠনের নেতা স্বামী প্রবোধানন্দ গিরি বলেছেন, ‘মিয়ানমারের মত আমাদের পুলিশ, রাজনৈতিক কর্মী, সেনাবাহিনী এবং প্রত্যেক হিন্দুকে অবশ্যই অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে এবং একটি ‘সাফাই অভিযানে’ নামতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নাই।’ হিন্দু মহাসভা পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাদ্বী অন্নপূর্ণা মুসলমানদের সংখ্যা কমাতে হলে অস্ত্র ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন। গত এক বছরে ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে এমন অনেক সংবাদ উঠে এসেছে, যেখানে সংঘ পরিবারের নেতারা প্রকাশ্যই মুসলমান নিধনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।
গত বছর অক্টোবরে টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘ইজ ইন্ডিয়া হেডেড ফর অ্যান এন্টি-মুসলিম জেনোসাইড?’ দেবাশিস রায় চৌধুরীর লেখা সেই প্রতিবেদনে ভারতে মুসলমান নিধনের নানামুখী তৎপরতার বেশ খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের শেষদিকে বলা হয়েছে, ভারতের ক্ষমতাসীনরা মুসলমানদেরকে ডিহিউম্যানাইজ করার সবরকম তৎপরতাই চালিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে নাজি জামার্নীতে ইহুদিদের ‘র্যাটস’ বা ইঁদুর তকমা দেয়া হয়েছিল, যেভাবে রুয়ান্ডায় হুতোরা তুতসিদের ‘ককরোচ’ বা তেলাপোকা বলে গণহত্যা করেছিল, ঠিক একইভাবে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা এখন মুসলমানদের ‘টারমাইট’ বা উইপোকা নাম দিয়ে গণহত্যার উস্কানি দিচ্ছে। প্রায় একই সময়ে ‘দ্য ওয়্যার’ অনলাইনে প্রকাশিত এক নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘ইজ ইন্ডিয়া লার্চিং ইন টু অ্যা জেনোসাইড?’ রিচার্ড ভন ওয়েজাকের ফেলোশিপপ্রাপ্ত অ্যাকাডেমিসিয়ান হার্স মান্দারের লেখা নিবন্ধটিতে ভারতে সম্ভাব্য গণহত্যার আশঙ্কা সম্পর্কে জেনোসাইড ওয়াচের পক্ষ থেকে গ্রেগরি স্ট্যান্টন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হলোকস্ট মিউজিয়ামের তরফে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক রিপোর্টের পর বিশ্বসম্প্রদায়ের নিরবতা নিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি এনডিটিভি’র একটি প্রতিবেদনের বরাতে বলেছেন, একটি গণহত্যার প্রাথমিক লক্ষণসমুহ ভারতের প্রায় সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বিজেপি ভারতের ক্ষমতায় বসার পর ভিআইপি হেইট স্পিচ বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মুসলিম বিদ্বেষী ঘৃণাসূচক বক্তব্য ১১৩০% বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিভিন্ন রাজ্যের মূখ্যমন্ত্ররা এবং ইউনিয়ন ও স্টেট মিনিস্টাররা নানা অজুহাতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোৎগার করে চলেছেন। ভারতে এখন হিন্দুত্ববাদী নেতাদের কণ্ঠে জার্মান নাৎসীদের কণ্ঠেরই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ভারতীয় নেতাদের মুসলমান বিদ্বেষী উত্তেজনা শ্রেফ রাজনৈতিক বোলচাল নয়। ভারতে ভোটের রাজনীতির চেয়েও অনেক বড় কিছু সংঘটিত করতে চাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষার প্রফেসর অপূর্বানন্দের লেখা এক নিবন্ধের শিরোনাম ‘মেজোরিটারিয়ান ভায়োলেন্স ইজ ¯েøালি টিয়ারিং ইন্ডিয়া এপার্ট’ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর ভায়োলেন্স ভারতকে ধীরে ধীরে বিভক্ত-খন্ডিত করে দিচ্ছে। গত জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আলজাজিরা অনলাইনে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। অবশ্য এর বহু আগে, গুজরাট দাঙ্গার পর দাঙ্গার বিভৎস চিত্র দেখে লেখক-সাংবাদিক খুশবন্ত সিং ‘এন্ড অব ইন্ডিয়া’ শিরোনামে লেখা দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। চরম জাত্যাভিমানি, সুপারম্যাসিস্ট ধারণাকে সামনে রেখে হিটলার জার্মান জাতিকে বিশ্বসভ্যতার মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, ভারতের বিজেপি নেতারা এখন সেই কাজটিই করছেন।
একদিকে জায়নবাদ অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাস বিশ্বে বড় ধরণের মানবিক সংকট সৃষ্টি করতে চলেছে। এবং কাকতালীয়ভাবে নয়, সম্ভবত সুদীর্ঘ পরিকল্পনার আওতায় এই দুই বর্ণবাদী শক্তি এখন ভ’-রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে গাঁটছড়া বেঁধেছে। ইঙ্গ-মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তাদেরই যৌথ প্রযোজনায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনীদের উপর নিপীড়নের স্টিমরোলার চালাচ্ছে ৭ দশক ধরে। অন্যদিকে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরি মুসলমানদের উপরও ইসরাইলী আইডিএফ স্টাইলে দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়িয়েছে ভারতীয় বাহিনী। বিশ্বের বৃহত্তম একক মুসলমান জনগোষ্ঠির আবাসভূমি ভারত। বাণিজ্য এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলোর উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সে কারণেই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে ৭০ বছর ধরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে আসছিল ভারত। কিন্তু নরেন্দ্রমোদির নেতৃত্বে বিজেপি দিল্লীর ক্ষমতা লাভের পর ভারতের ২৫ কোটি মুসলমান নাগরিক এবং বিশ্বের শতকোটি মুসলমান ও উদারনৈতিক মানবিক বোধসম্পন্ন বিশ্বসম্প্রদায়ের আকাঙ্খার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জায়নবাদী ইসরাইলের সাথে গভীর ও নিবিড় কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলতে উদ্যোগী হন। নরেন্দ্র মোদিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি সাড়ম্বরে ইসরাইল সফরে গিয়েছেন অথচ ফিলিস্তিন ভূখÐে যাননি। ইতিপূর্বেও কোনো কোনো ভারতীয় নেতা ইসরাইল সফর করেছেন, একই সময়ে তারা ফিলিস্তিনেও সফর করে একটি ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করেছেন। নরেন্দ্র মোদির ইসরাইল সফরের সময়ে তৎকালীন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একটি অভূতপূর্ব উক্তি ডেলিভারি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত এবং ইসরাইলের সাথে নাকি স্বর্গে বিবাহ হয়েছিল! ‘ম্যারেজ মেড ইন দি হ্যাভেন’ এটি সম্ভবত একটি বিবলিক্যাল পংক্তি। পরবর্তিতে চীন সফরে গিয়েও নেতানিয়াহু একই পংক্তি উচ্চারণ করেছিলেন। চীন এবং ইসরাইলেরও নাকি স্বর্গে বিবাহ হয়েছিল। আরব মুসলমানদের ভূমি দখল করে দশকের পর দশক ধরে গণহত্যা ও নিপীড়ন চালিয়েও ইসরাইল একই সঙ্গে ভারত-চীন, আমেরিকা এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখছে। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে ভারত। কোটি কোটি ভারতীয় মুসলমানকে অস্তিত্বের সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েও তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। জায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের হিং¯্র থাবায় একদিকে ফিলিস্তিন অন্যদিকে কাশ্মির ও ভারতের মুসলমানরা গণহত্যার সম্মুখীন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মত ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোও এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হিন্দুত্ববাদের দ্বারা আক্রান্ত অথবা হুমকির সম্মুখীন। মুসলমানদের গণহত্যা ও সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভারতের অখন্ডতা রক্ষা করা অসম্ভব হতে পারে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।