Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পি কের অপকর্ম ও ডাকাতি

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০২২, ১২:০২ এএম

দেশে একের পর এক এই ধরনের আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও সবসময়ই অপরাধীরা পগাড়পার হওয়ার পরই কেন এসব খবর সামনে আসে? আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কেন আগেভাগে এসব জালিয়াতি রোধ করতে পারে না?

পি কে হালদার খুবই মেধাবী ও প্রতিভাবান ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পুরো প্রতিভা অপকর্ম ও ডাকাতি বিদ্যায় ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনের আইবিএ থেকে এমবিএ; পাশাপাশি চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ) সম্পন্ন করা প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। কীর্তিমানের নাকি মৃত্যু নেই। উনিও বেঁচে থাকবেন আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান বুয়েটের ছাত্র শিক্ষকদের হƒদয় মাঝে, কিন্তু সেটা নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও পদ-পদবি ব্যবহার করে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন এবং সেই টাকার সিংহভাগই বিদেশে পাচার করেছেন। কারও কারও হিসাবে তার আত্মসাৎকৃত টাকার অঙ্কটা ১০ হাজার কোটিরও বেশি।
একদিকে পাহাড়সম লুটপাট! অপরদিকে ২০০ টাকা কেজি সয়াবিন তেল! ৬০ টাকা কেজিতে মোটা চাল! দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নআয়ের মানুষের নাভিশ্বাস। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য হু হু করে বাড়ছে। খাদ্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম। কিন্তু সেই তুলনায় আয় বা বেতন বাড়ছে না। এই অবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষের জীবন জেরবার অবস্থায়। জীবন যাপনের ব্যয় মেটাতে প্রতিদিনই কাটছাঁট করতে হচ্ছে তালিকা। টান পড়েছে খাদ্য তালিকায়ও। অন্যদিকে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা বলা হলেও সত্যিকার অর্থে বেড়েছে কেবল আয়বৈষম্য। এরই মধ্যে দেশের পি কে হালদাররা প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের মদদপুষ্টরা ধনী থেকে অতি ধনী হচ্ছেন। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে, দরিদ্র অতি দরিদ্রে পরিণত হচ্ছে।
পি কে হালদার হাজার কোটি টাকা এক দিনে, এক মাসে অথবা এক বছরে আত্মসাৎ করেননি। আর এক দিনে তা পাচারও করেননি। তাছাড়া এ ধরনের লুটপাট একা করা সম্ভব নয়, এটা বুঝতে বড় মাপের বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করলো, অথচ আগে কেউ জানতে পারলো না! জনগণের টাকায় পোষা সরকারি চাকররা তাহলে কী করেন? পি কে হালদার ব্যাংক থেকে জোর করে, অস্ত্র ঠেকিয়ে ডাকাতি করে টাকা নেয়নি; বরং সরকারি কর্মচারীদের (ঘুষ দিয়ে) ম্যানেজ করে, ভূয়া কাগজ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুফ করেছেন। পি কে হালদারদের এই অভয়াশ্রম গড়ে দেয় কারা? পি কের আসল পৃষ্ঠপোষকরা সব সময়ের জন্য কি আড়ালেই থেকে যাবে? এই হালদারকে মালদার করার পেছনে অবদান রাখা তহবিলদাররা কোথায়? এসব লুণ্ঠনের শিল্পকলানামক বণ্টননামা গুপ্তই থেকে যাবে চিরকাল? এতো বড় একজন মানিলন্ডারিং মাফিয়া দেশ ছেড়ে যায়, আর দুর্নীতি দমন কমিশন টেরই পেলো না? কী করেন আর্থিক খাতের সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলরা? তারা কেন আগেভাগে কেলেঙ্কারি কিংবা জালিয়াতির ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে পারেন না? এর দায় তারা এড়াতে পারেন কি?
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং এইসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যে সব ব্যাংক লেনদেন করেছে এদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। শিঁকড়-বাঁকড়সহ তুলতে না পারলে নিশ্চিত দেশ পথ হারাবে। পি কে হালদাররা দেশের শত্রু, দেশের উন্নয়নের চরম অন্তরায়, ওদের আঁতুড়ঘর ভাঙতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দ দেখার জন্য আছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু একজন লোক কীভাবে একটা দুইটা না, চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট করে মুমূর্ষু করে দিয়ে গেল। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা নয় কী?
গত ১৫ মে ভারতের অর্থ গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) সেখানকার অশোকনগর থেকে পি কে হালদারকে তার ছোট ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও কয়েকজন সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে। ভারতে গিয়ে পি কে হালদার নিজের পরিচয় গোপন করে শিবশঙ্কর হালদার নামে দেশটির পরিচয়পত্র, নাগরিকত্বের সনদ, আয়কর দপ্তরের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ইত্যাদি সংগ্রহ করে সেখানে বাড়ি কেনেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এতে বোঝা যায়, পি কে হালদারের কালো হাত কতটা প্রসারিত ছিলো। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের (ব্যাংকিং এবং নন ব্যাংকিং) দৈন্যদশার জন্য দায়ী কারা? সর্বসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, করে যাচ্ছে তারা কারা? প্রশান্ত কুমার হালদাররের জš§ একটি জবাবদিহিহীন দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়া চক্রের হাতে। মাত্র ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৯ সালে পি কে হালদার অদৃশ্য আশীর্বাদে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদও বাগিয়ে নেন।
এই পি কে হালদার লুটতারাজ শুরু করছে ২০১৪ এর আগে থেকে। তাহলে এতদিন সরকারি সংস্থাগুলো কেনো তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন বা তদন্তে যায়নি? গোয়েন্দা বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সংবাদমাধ্যম যেসব চিত্র তুলে ধরেছে, তাতে প্রশ্ন উঠবেই- দায়িত্বশীল এত সংস্থার চোখে ধুলো দিয়ে কীভাবে এতো টাকা পাচার করলো?
পি কে হালদারকে কীভাবে ফেরানো যাবে? কতদিন লাগবে? পাচারকৃত অর্থ কীভাবে আনা যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর অত সহজ নয়। কী পরিমাণ মামলা ভারতে হয়েছে, সে মামলাগুলোর বিচারে কত দিন লাগবে বা বিচারের আগে ফেরত আনা যাবে, কি যাবে না, সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারবে না। হয়তো পি কে হালদারকে ভারত থেকে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু ভারতে পি কে হালদারের বিনিয়োগকৃত সম্পদ, পশ্চিবঙ্গে প্রাসাদোপম একাধিক বাড়ি, উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরে চার বিঘা জমির ওপর সুরম্য বাগানবাড়ি ছাড়াও কয়েকশ বিঘা মূল্যবান সম্পত্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কী? এছাড়া পালিয়ে তিনি কানাডায় ছিলেন লম্বা সময়, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রেও ছিলেন। সেসব দেশেও তার বাড়ি বা সম্পদ থাকা অসংগত নয়। অর্থ ফেরত আনার পদ্ধতিটা খুব জটিল এবং এর সাফল্য খুবই কম। মানে, বাংলাদেশের অবস্থা হবেÑ ‘মাইরও খাবা, টাকাও খোয়াবা, আর কাঁদবা ফাউ!’ দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বলছে, একাধিক নারীকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়েছেন পি কে হালদার, যার পরিমাণ ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ঋণ সুবিধার পাশাপাশি উপহার হিসেবে দিয়েছেন বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। এর মধ্যে নাহিদা রুনাইকে দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের শেয়ার কিনে উপহার দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ৮০০ কোটি টাকা খরচ করে পিপলস লিজিংয়ের শেয়ার কিনে উপহার দিয়েছেন অবন্তিকা বড়ালকে। নাহিদাকে বিভিন্ন সময় ২০ কোটি টাকা দিয়েছেন বলেও দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে উঠে এসেছে। অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইকে সঙ্গে নিয়ে আলাদাভাবে ৬০ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রুনাই ও অবন্তিকার সঙ্গে আলাদা সময় কাটাতেন। শুধু নাহিদা রুনাইকে ভারতে নিয়ে গেছেন ২২ বার। তাকে ২০ কোটি টাকা দেওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। সুন্দরী প্রেমিকা অবন্তিকাকে ধানমন্ডিতে ৫ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। তার আইনজীবী সুকুমার মৃধার মেয়ে অনন্দিতা মৃধাকে উত্তরায় ৯ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন। সুস্মিতা সাহাকে ১০০ কোটি, পাপিয়া ব্যানার্জি ও মমতাজকে দেওয়া হয়েছে ৩০০ কোটি করে ৬০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ। ভাইয়ের স্ত্রী সুস্মিতা সাহাকে ১০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া এসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই অনিশ্চিত।
পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই প্রতিষ্ঠান দখল ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। পি কে হালদারের দখল করা প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে গড়ে তুলেছেন একাধিক কাগুজে প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান। কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন।
দেশে একের পর এক এই ধরনের আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও সবসময়ই অপরাধীরা পগাড়পার হওয়ার পরই কেন এসব খবর সামনে আসে? আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কেন আগেভাগে এসব জালিয়াতি রোধ করতে পারে না? আমরা মনে করি, এখনই সরকারের পক্ষ থেকে এসব অপরাধ শক্ত হাতে দমন করতে হবে। না হলে আর্থিক খাতকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে, যার পরিণতি কারও জন্য সুখকর হবে না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী



 

Show all comments
  • Mohammed Shah Jahan ২২ মে, ২০২২, ৮:৩৮ এএম says : 0
    পি কে হালদার যাদের জন্য বা যত বেনেফিসিয়ারি আছে সবাইকে জেলে ঢুকাতে হবে। কে উ যেন ভোগ করতে না পারে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পি কের অপকর্ম ও ডাকাতি
আরও পড়ুন