পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১০ এপ্রিল ২০২২ পাকিস্তানে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরানের পিটিআই সরকারের পতন হয়। এটা পাকিস্তানে প্রথম। এর আগে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে জনগণের নির্বাচিত সরকার কখনো অনাস্থা ভোটে হারেনি। পাকিস্তানে দুই খানের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানের সর্বপ্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলি খান (১৯৪৭-১৯৫১)। ৪ বছর ২ মাস তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানে ২২তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান। তিনি ১৮ আগস্ট ২০১৮ থেকে ১০ এপ্রিল ২০২২ পযর্ন্ত ৩ বছর ৭ মাস ২৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানে ২২ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউ মেয়াদকাল (৫ বছর) পযর্ন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেননি। এর অনেক কারণের মধ্যে প্রধান কারণ সেনাবাহিনী। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক আয়েসা সিদ্দিকা বলেছেন, পাকিস্তানে জনগণের নির্বাচিত সরকার পুরো মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। কেন পারেনি এবং সমস্যা কোথায়?
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও রাজনৈতিক কোন্দল আছে, জাতিগত সমস্যা এবং অর্থনৈতিক মন্দা আছে। সেখানে একটি চৌকস শক্তিশালী সেনাবাহিনী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও কখনো ভারতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেনি বা চেষ্টাও করেনি। ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। শুধুমাত্র বহিঃশক্তির হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য সেনাপ্রধান মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সেটাও রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষ হতে হবে। তারা মনে করে, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদরাই সমাধান করবে। প্রতিবেশী দুইটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপরিচালনায় ভিন্নতা বলতে গেলে অবাক হওয়ার মতো।
পাকিস্তানে রাজনীতি এবং সরকার পরিবর্তন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। আর ভারতে সরকারের শতভাগ নিয়ন্ত্রণে থাকে সেনাবাহিনী। কখনোই সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ে ভাবে না। সরকারে কে আসবে বা কে যাবে তা নির্ধারণ করে জনগণ। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার কারণে ভারতে কখনোই সামরিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত গণতন্ত্রের একটি মডেল রাষ্ট্র হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছে, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অন্যকোনো রাষ্ট্র এমন নজির স্থাপন করতে পারেনি। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে (১৯৪৭) সিভিল জবে সর্বক্ষেত্রে ২৫% বরাদ্দ দিতে হবে সেনাবাহিনীকে। অবশেষে সেটা বাস্তবায়িত হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ধস ঠেকাতে চাইলে দুই তৃতীয়াংশ আসনে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে বিজয় অর্জন করতে হবে। সেটা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পিটিআই অর্জনে ব্যর্থ হয়।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ নিশ্চিতরূপে তিন টার্মে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পেরেছে। পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক দল সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ইমরানের পিটিআই দলকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়। এক কথায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। পাকিস্তানে সরকার পরিচালনা করতে চাইলে সেনাপ্রধানকে পক্ষে আনতে হবে। সেনাবাহিনীর বিপক্ষে কাজ করলে সেই সরকার পাকিস্তানে অতীতেও টিকে থাকতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। ইমরান খানের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছে। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে ইমরান খানের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।
ক্ষমতাসীন জোটের কিছু শরিক দল (২০টি আসন) অনাস্থা ভোটে বিরোধী দলকে সমর্থন করে। শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হন। গণমাধ্যমে এসেছে, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ধবংস করেছে তিন পুতুল-নওয়াজ, ভুট্টো এবং এমকিউএম। মোটা অংকের আর্থিক লাভের জন্য তারা এ কাজটি করেছে। পাকিস্তানের মানুষ তাদের মিস্টার ১০% এন্ড মিস্টার ১৫% হিসেবে অভিহিত করেন (সূত্র ডন)। এমনকি নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ তার দল নিয়ে উমরাহ পালনের সময় তাদের বিরুদ্ধে ‘চোর’ ‘চোর’ বলে ধিক্কার জানিয়েছে ওমরাহ পালনকারী পাকিস্তানের জনগণ। এদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন মামলা আছে। সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগ এক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রাজনীতির বাইরে রাখুন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, দেশের ভালোর জন্য সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে জড়াবেন না (সূত্র: দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউন)। এটা সেনাবাহিনীর জন্য একটি ভালো উপলব্ধি।
বহু বছর ধরে আমেরিকার উপর নির্ভরশীল মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। ছয় দশক ধরে আমেরিকা এশিয়া মহাদেশে নিজের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট ছিলো। যেসমস্ত দেশ তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল, বিনিময়ে তারা কিছুই পায়নি। আমেরিকা অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করেছে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে। ইমরান খান যথার্থই বলেছিলেন, বিশ্বে আমাদের বন্ধু আছে কিন্তু প্রভু নেই। বন্ধুত্বের লেবাস পরে অবশেষে প্রভুত্বের জয়জয়কার সর্বত্র। এরা মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে আমেরিকা এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা শক্তি নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এমতাবস্থায় একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিই পাকিস্তানকে তার গণতন্ত্র এবং স্বীয় মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে বলে অনেকে মনে করেন। নানা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রিয় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ক্ষমতা হারানোর পর ইমরানের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে (সূত্র: ডন)।
সর্বশেষ আবারও বলবো, যে কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্রে ধস নেমেছে সেটা মেরামত করতে হবে। প্রথমে সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি সরকারে অধীনে রাখতে হবে। ভারতের আইনী বিধান এ ব্যাপারে বিবেচনা করা যেতে পারে। উপরন্তু সংবিধানে এমন একটি আইনী ধারা সংযোজন করা উচিত, যার ফলে ভবিষ্যতে অনাস্থা ভোটে সরকারের পতন না হয়। এমন ব্যবস্থাও থাকা উচিত, যাতে সাংবিধানিক আইনের তথা সংসদীয় আইনের উপর কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে না পারে এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তাই করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্য নিয়ে সংসদীয় আইন পাস হয়। তার উপর বিচারিক আদালত কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করলে এক কথায় তা সংবিধান পরিপন্থী হিসেবে গণ্য হয়। আমরা চাই, পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনর্জীবিত ও স্থায়ী হোক। এটা শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বরং উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও প্রয়োজন।
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক।
[email protected].
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।