পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সময়ের পরিবর্তনে অনলাইনে কেনাকাটা এখন এতটাই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, আমরা এতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বাজার বা মার্কেটে না গিয়ে ঘরে বসে এক ক্লিকেই পছন্দসই পণ্য হাতে আসায় মানুষ অধিক হারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে অনলাইন কেনাকাটায়। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের কারণে ২০-২১ সালে দেশের ছোট-বড় সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই ক্ষতি কাটাতে রীতিমতো হিমশিম খেয়েছে ব্যবসায়ীরা। আর সে সময় যে সব ব্যবসায়ী অনলাইনে কেনাবেচা শুরু করেছিলেন তাদের জন্য করোনাকালীন সময়টা পৌষ মাস বলা যায়। দিন দিন অনলাইন ব্যবসায় গতি আসে। ফলে দেশে অনলাইনে ব্যবসা বেড়েছে শতগুণ। লেনদেনও হয়েছে বহুগুণ বেশি। বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম রয়েছে অন্তত ৯৫০ এবং সেখানে দৈনিক ৪৫ হাজারের মতো পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের তথ্য মতে, বর্তমানে অনলাইন সেবা চালু রেখেছে সাড়ে ৭০০-এর বেশি অনলাইন শপ। আর ফেসবুকে পেজ খুলে পণ্য বিক্রি করছে আরও ১০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান। এদের অধিকাংশই যে বেকার ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনোরকম খরচ ছাড়াই কিংবা স্বল্পমূল্যে পণ্য কেনাবেচার পরিবেশই মূলত এ প্ল্যাটফর্মে তাদেরকে আগ্রহী করে তুলেছে। মূলত জীবনকে সহজ করে দিতে ই-কমার্সের জন্ম। অনলাইনে দেশে-দেশে ক্রয়-বিক্রয়ের ধরন-ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। ভিড় ঠেলে বাজারে যেতে হয় না।
আর এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে কেন্দ্র করেই তৈরি হচ্ছে নানা কর্মসংস্থান; বদলে যাচ্ছে বহু তরুণ উদ্যোক্তার ভাগ্য। তবে প্রশ্ন উঠেছে নির্ভরযোগ্য সাইট নিয়ে! বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বড় দুর্ভাগা। অনলাইন-ইকমার্সের নামে এক একটি ঠকবাজির ঘটনা ধরা পড়ছে। পিলে চমকানো অবিশ্বাস্য কাণ্ডকীর্তি।
ভারতের সেরা ব্র্যান্ডের শাড়ি, পাকিস্তানের থ্রিপিস, থাইল্যান্ডের জুতা, ব্যাগ, ফ্রান্সের পারফিউম, সরাসরি দুবাই, আমেরিকা থেকে আনা কসমেটিকস্ তাও অর্ধেক দামে। এমন লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে তারা। তবে শর্ত একটাই, এ সকল পণ্য সংগ্রহ করতে হবে কুরিয়ার থেকে। আর কুরিয়ার চার্জ পাঠাতে হবে বিকাশ কিংবা নগদে। সস্তায় ভালো মানের সেরা ব্র্যান্ডের পণ্যের এমন বিজ্ঞাপন দেখে সাতপাঁচ না ভেবেই অর্ডার করেন ক্রেতারা। কিন্তু হাতে পাওয়া প্যাকেট খুলে দেখেন পুরোটাই প্রতারণা।
জানা গেছে, ফেইসবুকে ভূয়া ই-কমার্স পাতা খুলে বিভিন্ন দেশের সেরা ব্র্যান্ডের ছেলে-মেয়েদের পোশাক, ঘড়ি, জুতা, মোবাইলসহ নানা ধরনের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে ফাঁদ পাতে তারা। তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন থেকে কেউ যখন অর্ডার কনর্ফাম করে তখনই একটা বুকিং মানি নেয়। এরপর নকল, ভাঙাচোরা, নষ্ট ও নিম্নমানের ব্যবহারের অনুপোযোগী পণ্য চাকচিক্যময় প্যাকিং করে কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেয়।
এদের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে গ্রেফতার বা ব্যবসা সিলগালার মতো কিছু ঘটে গেলে কদিন ঝিম মেরে থেকে এরা আবার গজায়। হয় ভিন্ন নামে। নয় নতুন আইটেমে। এখানে প্রতারকদের সাফল্যের পেছনে ‘সাধারণ জনগণ’ নামক মানুষের অসচেতনতা ও অতি আগ্রহের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। একদিকে যেভাবে বাড়ছে অনলাইন শপিং, সাইটগুলোতে ঠিক তেমনিভাবেই বাড়ছে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার হার। ই-কমার্সের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বা চাহিদাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ের নামে প্রতারণার জাল বুনেছে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী অসাধু চক্র।
এই প্রতারণার মাত্রা বাড়ে ঈদসহ নানা উৎসবে, ফলে প্রতারণার নানা ঘটনায় অনলাইন কেনাকাটা, ই-কমার্স শুনলেই যেখানে মানুষের পালানোর কথা; সেখানে ঈদ মৌসুমে উল্টো হুমড়ি খাওয়ার সংস্কৃতি আরও গতিময়। প্রচুর ক্লায়েন্ট তাদের। মৌসুম পাগল ক্রেতাদের ঈদের কেনাকাটায় সমানে ঠকবাজি, জোচ্চুরিতে ফেলে মৌজ-মাস্তি করছে ই-প্রতারকরা। এরপরও একদল মানুষ পণ্য কিনতে বিভিন্ন কোম্পানিতে টাকা জমা দিচ্ছে; সেই কোম্পানি পণ্য দিচ্ছে না, টাকাও ফেরত দিচ্ছে না; পেছনে না ফিরে চলে যাচ্ছে আরেক কোম্পানির খপ্পরে। রীতিমতো আচানক অবস্থা। ঠকিরা দমে না। দম নেয় না ঠকের শিকাররাও।
ঈদ রাজ্যে ঠকে স্বস্তি, ঠকিয়ে মাস্তি ঈদে বিশেষ ছাড়ে খুশি। গিফটে আরও খুশি, মহাখুশি। ক্রেতাকূলের এ খুশির আড়ালে বিক্রেতাদের তৃপ্তির হাসি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের অভিযানে মাঝেমধ্যে কিছু ঠকবাজি ধরা পড়ছে। আদায় করা হচ্ছে জরিমানা। হাতেনাতে ধরা পড়া প্রতারকের বক্তব্যসহ কীভাবে ছাড়, অফার, গিফটের নামে পকেট কাটা হচ্ছে সবিস্তারে তার বর্ণনা প্রচার করছে গণমাধ্যম। জনসাধারণকে সতর্ক করা হচ্ছে। অভিযানকারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব লোভে পড়ে প্রতারিত না হতে। কে শোনে কার কথা?
তাদের এ লোভ বিক্রেতাদের লাভ নিশ্চিত করছে। এরা সেই অপেক্ষাই করে। এক আইটেম বা পেশায় ধরা পড়লে, জরিমানা দিয়েও দ্রুত চলে যায় আরেকটাতে। সময় নষ্ট করে না। করোনার দুই বছরের ক্ষতি এবারের এক ঈদেই পুষিয়ে নেওয়ার উদাম দৌড়ে নেমেছে তারা। ইফতার-সেহরি স্পর্শকাতর বিষয়। এ নিয়ে কিছু বলাও মুসকিল। এ সুযোগে অতিক্রয়-অতিভোজ চলেছে মাস জুড়ে। বেগুনি, ছোলা, শসা, পেঁয়াজু- ইফতারিতে অবশ্যই মুখরোচক আইটেম। তবে নিত্যপণ্য নয়। পেট পুরে খাওয়ার মতো আইটেম নয়। তাহলে কোনো কারণে একসঙ্গে দুই চার কেজি বা আরও বেশি কেনার প্রতিযোগিতা থাকবে? তাই এ মানসিকতা বাজারে ক্রাইসিস তৈরি এবং সিন্ডিকেটকে সুযোগ করে দেওয়ার মহৌষধ। কিছুটা কমিয়ে কিনলে বাজারের চিত্র ভিন্ন হতে পারতো। এতো পরাক্রমশালী হয়ে উঠতে পারতো না সিন্ডিকেট। তাদের একটুও বয়কট না করে বরং সহযোগী ভূমিকা দেশের বেশিরভাগ ক্রেতার। এ কোটি কোটি মানুষের ভূমিকা হাতে গোনা কিছু ব্যবসায়ীকে নিত্যপন্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের কী সাফল্য এনে দিচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা দরকার।
সারা মাস জুড়ে অনেকের ইফতার-সেহেরির বহর এবং ঈদের কেনাকাটার ধুম কি দেশে অভাবের ইঙ্গিত দেয়? এমন প্রশ্নও ঝুঁকিপূর্ণ। পাল্টা প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়ায় এক্সট্রিম লেভেল। তারা বুঝতে নারাজ তাদের দেখানো প্রতিক্রিয়া নিজের জন্য, ধর্মের জন্য, এমন কি দেশের জন্যও শুভ নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশে মিনিকেট বলে কোনো ধান নেই, চালতো অবশ্যই নেই। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সতর্কতামূলক প্রচার-প্রকাশ কম হয়নি। তারওপর খাদ্যমন্ত্রীও বলেছেন। এরপরও বাজারে মিনিকেট চালের কাস্টমারের কোনো কমতি নেই। কী দাঁড়ায় অর্থটা? প্রতারিত হতে বা ঠকতে আগ্রহীর সংখ্যাও দেশে কম? ক্রেতাকূল সতর্কতার বদলে ঠকে তৃপ্ত হলে বিক্রেতা খুশি না হয়ে পারে? প্রতারণা সংক্রান্ত কুখবরের ছড়াছড়ি। ধরা পড়ছে কিছু কিছু। কিন্তু, তাতে কী? ক্রেতারাই ঠকতে চাইলে বিক্রেতাদের ঠকানো ঠেকানোর সাধ্য কার? সরকারেরই বা করার কী আছে এখানে? ঘাড়তেড়া অন্ধের মতো অন্ধকারে ভালো দেখা যায় দাবি করার বিপরীতে কারোই করণীয়ও কিছু থাকে না।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই। গত কয়েক বছরে এর পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ই-কমার্সকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসতে একটি নীতিমালা তৈরির কথা বলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেখানে পণ্যের অর্ডার দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া, তাতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া মূল্য জরিমানাসহ ফেরত দেওয়া, খারাপ, মানহীন পণ্য সরবরাহকে ফৌজদারি আওতায় প্রতারণা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটি দরকার, তা হচ্ছে সচেতনতা। কোনো আকর্ষণীয় অফার বা বিজ্ঞাপন দেখে হুট করে পণ্য কিনতে যাওয়া ঠিক নয়। প্রথমেই প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা, ট্রেন্ড লাইসেন্স, মালিকের নাম-ঠিকানা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। কুরিয়ারে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে রসিদ ও ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য গ্রহণ করতে হবে। ফেসবুক কেনাকাটার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য পেজ বা গ্রুপ থেকে কেনা এবং রিভিউ দেখে নিতে হবে। কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ ও জনগণের সচেতনতায় অনলাইন মার্কেটিং তথা ই-কমার্স আস্থা ফিরে পাবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।