পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের বহুল আলোচিত আর্থিক খাতের শীর্ষ জালিয়াত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) অবশেষে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে যান কানাডায়। কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখান থেকে ভারতে আসেন সম্প্রতি। ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গত শনিবার তাকে ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করে। ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রমতে, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও বসবাস, নামে-বেনামে সম্পতি কেনা এবং আইনবহির্ভূতভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অর্থ আনা ইত্যাদি অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ইডি জানিয়েছে, পি কে হালদার নিজেকে শিব শংকর হালদার পরিচয় দিয়ে ভারতের একাধিক সরকারি পরিচয়পত্র যেমন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর দফতরের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র ইত্যাদি জোগাড় করেন। তার সহযোগীরাও একই কাজ করেছেন। ইডি তার বিবৃতিতে বলেছে, পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় সম্পদ কিনেছিলেন। কলকাতার কিছু অভিজাত এলাকায় তাদের কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। পি কে হালদার বাংলাদেশে বহু কোটি টাকার আর্থিক কেলেংকারিতে জড়িত বলে উল্লেখ করে ইডির মন্তব্য: ‘এ টাকার বিরাট অংশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাঠানো হয়েছে।’ পি কে হালদার বাংলাদেশের আর্থিক খাত থেকে কী পরিমাণ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে হস্তগত ও পাচার করেছেন তার সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় যে, এই শীর্ষ জালিয়াত অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংক থেকে পি কে হালদার সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জব্দ করা টাকার পরিমাণ ১৪০০ কোটি টাকা। আর তিনি পাচার করেছেন সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের বিএফআইইউ পরিচালিত তদন্তে।
পি কে হালদার প্রথমে ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরে তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি হন। তখন থেকেই তার আর্থিক জালিয়াতি শুরু। ২০১৪ সালের পর পি কে হালদার নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠা করেন বিভিন্ন ভূয়া কোম্পানি। এগুলোর নামে শেয়ার কিনে একে একে ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তিনি নিয়ন্ত্রণে নেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। যতদূর জানা যায়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা, পিপল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস থেকে ৫০০ কোটি টাকা, এএফএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে ৫১০ কোটি টাকা, রিলায়েন্সে ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে ৪০০ কোটি টাকা, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক থেকে ৭০০ কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এরূপ সুপরিকল্পিতভাবে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেন। তার একাজে সহযোগিতা করেন বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, বিশেষভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর এস কে সুর চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও কয়েকজন কর্মকর্তা। তার অপকর্মে নানাভাবে সহযোগিতা করেন দেড় ডজন মহিলাসহ শতাধিক ব্যক্তি। এভাবে তিনি অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে তুলেছিলেন। ভারতেই শুধু নয়, কানাডা ও অন্যান্য দেশেও তিনি আত্মসাৎকৃত অর্থ পাচার করেছেন এবং ওইসব দেশে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ আছে। উপযুক্ত খোঁজখবর ও তদন্তে সব কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতে তার গ্রেফতারের খবরে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তার সহযোগীরা। পি কে হালদার ও তার সহযোগিতাকারীদের অপরাধ অমার্জনীয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের প্রাপ্য। দ্রুতই তাদের আইনের শৃংখলে আটকাতে হবে। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম বলেছেন, তাকে দেশে আনতে ৩ থেকে ৬ মাস লাগতে পারে। বলা বাহুল্য, পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার আর্থিকখাতে যে আনাস্থার পরিবেশ তৈরি করেছে তা অপনোদানে দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি একান্তভাবেই কাম্য।
পি কে হালদারের গ্রেফতার আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের জন্য ভালো সংকেত বলে মনে করছেন অনেকেই। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, ওইসব প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকদের টাকা ফেরৎ দিতে পারছে না। গ্রাহকরা হাহাকার করছে। টাকা ফেরৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায়, কিছুটা আলোর রেখা দেখা গিয়েছে। পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ গ্রাহকদের টাকা ফেরৎ দেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট ও দুদককে দ্রুত তদন্ত শেষ করতে হবে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরৎ আনার ব্যবস্থা করতে হবে। পি কে ও তার সহযোগীদের কাছে থাকা অর্থ উদ্ধার করতে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব ফেরৎ আনা ও উদ্ধার করা অর্থ গ্রাহকদের হাতে তুলে দিতে হবে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এ যাবৎ পাচার হয়ে যাওয়া অর্থের অতি সামান্যই ফেরৎ আনা সম্ভব হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশেই রয়ে গেছে। এ অর্থ দেশের ও জনগণের কোনো কাজে আসছে না। পি কে’র আত্মসাৎ ও পাচারকৃত অর্থ এনে গ্রাহকদের দিতে পারলে এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানখাতে সস্তি ফিরে আসবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ও ফাঁক-ফোকড় থাকার কারণেই পি কে হালদারের মতো লোক বছরের পর বছর ধরে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করতে পেরেছেন। অবশ্যই এখাতে ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন, নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।