Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা নিধন চলছেই, দেখার কেউ নেই

প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ২:৫৮ পিএম, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানরা সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের হাতে সমকালীন ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকা- ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন পেরিয়ে মিয়ানমার যখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গত বছর গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রায় শামিল হয়, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে গণতন্ত্রবাদী নেত্রী অং সান সুচি’র কাছে সবচে বেশী প্রত্যাশিত বিষয় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার রাখাইনদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবিটি উঠে এসেছিল। এ বিষয়ে সবার দৃষ্টি ছিল নতুন সরকারের পরবর্তী উদ্যোগ বা পদক্ষেপের দিকে। তবে এরই মধ্যে সর্বমহলে একটি হতাশাজনক বার্তা পৌঁছে গেছে, তা’ হচ্ছে, লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের ভাগ্য নির্ধারণে মিয়ানমারের নতুন সরকার তেমন কিছুই করেনি। সরকার মূলত সাবেক জান্তা সরকারের গৃহীত এথনিক ক্লিনজিং-এর পথই বেছে নিয়েছে। গত কয়েক মাসে রাখাইনের মুসলমান নাগরিকদের উপর সামরিক বাহিনীর আগ্রাসন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে। গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে গত কয়েকদিনে রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযানে অন্তত ৮৬ জন নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে আগুন দিয়ে নারী ও শিশুসহ নির্বিচার হত্যাকা-ের ঘটনার কিছু কিছু চিত্র গণমাধ্যমে এসেছিল। এবার রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত প্রত্যন্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে গুলি করে সাধারণ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের উপর জুলম-নির্যাতনের ইতিহাস বহু পুরনো। মধ্যযুগে আরাকান রাজ্যের মুসলিম অধিবাসীরাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। আরাকানের রোসাঙ্গ রাজ দরবারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ও উৎকর্ষ ঘটেছিল। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সন্নিহিত এলাকায় প্রায় একই ধরনের ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির কারণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার বিভিন্ন সময়ে জাতিগত সংঘাতে আত্মরক্ষার্থে সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বা পুনর্বাসিত করার দাবিকে এই বলে অগ্রাহ্য করে এদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করছে। ১৯৪০ সালে যখন উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানরা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবীতে আন্দোলন করছিল, তখন আরাকানের মুসলমানরাও একটি আলাদা আবাসভূমির দাবি তুলেছিল। তবে তাদের মধ্যে উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকায় তা’ অঙ্কুরেই অবদমিত হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে জাপানী বাহিনী বার্মা দখল করার পর ব্রিটিশ বাহিনী কক্সবাজার দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করার সময় ২২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীও এখানে এসেছিল বলে জানা যায়। সে সময় রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা ব্রিটিশ শাসিত বাংলাদেশে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না হলেও উপনিবেশোত্তর উপমহাদেশে জাতি হিসেবে রোহিঙ্গাদের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অগ্রাহ্য হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এখনো হত্যা, নির্যাতন ও জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। ষাটের দশক থেকে একচেটিয়া সামরিক শাসনে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের দাবিকে, রাখাইনের বৌদ্ধদের সাথে রোহিঙ্গাদের জাতিগত বিভেদকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন নাগামিন’ নামের একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনার সময় সেখান থেকে ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। এরপর ১৯৮২ সালে সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে গৃহীত একটি কালো আইনের দ্বারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের দাবিকে চরমভাবে পদদলিত করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সনদের প্রেক্ষাপটে অগ্রহণযোগ্য সেই কালো আইনটি পরিবর্তন করে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানের প্রশ্নে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারের সাথে দুই শতাধিক কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের পূর্বদিকের বিশাল দুনিয়ার সাথে স্থল যোগাযোগ ও এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযুক্তির প্রধান গেটওয়ে হচ্ছে মিয়ানমার। এসব বিবেচনায় মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুটি অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে বাংলাদেশ দশকের পর দশক ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ সামলাচ্ছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গা নাগরিকরা নানা ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরী করছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের উপর নতুন করে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা দুই দেশের সীমান্তেই বাড়তি উত্তেজনা তৈরী করছে। সামরিক বাহিনী এবং বৌদ্ধদের সহিংসতা থেকে বাঁচতে এখনো প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা তাদেরকে পুশব্যাক করে অমানবিক দুর্দশায় ঠেলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। সামরিক শাসনের আমল থেকে রাখাইনের জাতিগত সংঘাতের ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে তুলে আনার ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা এখনো অব্যাহত আছে। সেখানে বছরের পর বছর ধরে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টির বাইরে রেখে অনেক নির্মম জাতিগত নৃশংসতার জন্ম দেয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত। মানবেতর ও রাষ্ট্রহীন জাতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা আমাদেরকে স্পর্শ করেছে বহু আগেই, আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের ভাগ্য এবং মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কোন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত ইস্যুটি নিয়ে আমাদের আরো বেশী কিছু করণীয় আছে। মুসলমানদের মানবাধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমা সরকার ও সংস্থাগুলোর একচোখা নীতি থাকতে পারে। নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সরকার, মানবাধিকার সংস্থা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা নিধন চলছেই
আরও পড়ুন