Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার সঙ্কট বাড়ছে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০২২, ১২:০২ এএম

যেভাবেই গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, মোটা দাগে বলতে হয়, একটি গোষ্ঠী, রাষ্ট্র বা সমাজের সংখ্যাধিক্য মানুষের স্বচ্ছ ও প্রভাবমুক্ত মতামতকে প্রাধান্য দেয়াই গণতন্ত্র। সংখ্যাধিক্যের সমর্থন আদায় করার বিভিন্ন পদ্ধতি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান। হাতির খাওয়ার দাঁত অনেক, কিন্তু প্রদর্শনের দাঁত দুইটি। এ দাঁত দুইটি হাতি প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করলেও খাদ্যগ্রহণে কোন কাজে লাগে না। অনুরূপ গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও বাস্তবতা আকাশ-পাতাল তফাৎ। সংখ্যাধিক্ষ্য জনগণের সমর্থন নিয়েই সরকার বা রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট যে কোন সংগঠন পরিচালিত হওয়ার কথা, যদিও এ কথাগুলি রাজনীতির ব্যাকরণের মুখরোচক বুলির মতই শুনতে ভালো শোনা যায়। কিন্তু এর স্বাদ অনেক তেতো। কারণ বাস্তবতা অনেক ভিন্নতর। স্বচ্ছ, প্রভাবমুক্ত ও নিরাপত্তামূলক পরিবেশ গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এটাও বলেছেন যে, যিনি ভোট দাতা বা সমর্থনকারী তাকে সর্বপ্রকার ভয়ভীতির উর্দ্ধে থেকে ভোট প্রদানের নিশ্চয়তাই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। ভয়ভীতিবিহীন পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কারণ সংবিধান রাষ্ট্রকে এ দায়িত্ব প্রদান করেছে। যে রাষ্ট্র লিখিত বা অলিখিত সংবিধান মোতাবেক চলে না তাদের কথা ভিন্ন। কারণ, সে রাষ্ট্র জনগণের মতামতের উপর চলে না। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র রয়েছে, যেখানে রাজতন্ত্র গৌন হয়ে জনগণের অধিকারই পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আবার পৃথিবীতে অনেক এমন রাষ্ট্রও রয়েছে, যেখানে সংবিধান মোতাবেক নামে গণতন্ত্র থাকলেও এর বাস্তবতা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র রয়েছে, যেখানে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কার্যত: পরিবর্তন হয়েছে এবং বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয়েছে জোর যার মুলুøক তার। এখন বাস্তবতার নিরিখে এটা পর্যালোচনা করতে হয় যে, এই ‘জোর’ অর্থাৎ ‘শক্তি’র উৎস কোথায়?

রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার কথা জনগণের কল্যাণে, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। যেকোন বিষয়ে জনগণ থাকবে মর্যাদার আসনে। এ কথা বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) এবং ২১(২) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু জনগণের মর্যাদা আজ কোথায়? গণদাবী বা জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন কি সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য, নাকি শাসনকর্তা জনগণের জন্য যতটুকু অধিকার দিতে স্বাচ্ছন্ধ বোধ করে ততটুকুই জনগণের ভাগ্যে বরাদ্ধ হয়ে থাকে। জনগণের অধিকার কোথায় আছে তা একটু পর্যালোচনা করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ধানমন্ডির তেতুলতলায় খেলার মাঠে পুলিশ ভবন নির্মাণের প্রতিবাদ করায় মা/ছেলেকে পুলিশ বেআইনীভাবে ১০/১২ ঘন্টা থানায় আটকে রাখে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তেতুলতলার জায়গার মালিক পুলিশ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সত্য মেনেই বলতে হয় যে, কাগজে কলমে জায়গার মালিক পুলিশ হলেও জনগণের দাবী-দাওয়ার কি কোন মূল্য নাই? মুখে বলে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী, আর একজন নারী একটি গণদাবী নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় পরিনতি কি পুত্রসহ থানায় আটকে রাখা? এটা কি ভয়ভীতি দেখানোর নামান্তর নহে? ঘটনা প্রসঙ্গে বিষয়টি উল্লেখ করলেও বাংলাদেশে এর চেয়ে অনেক বেশী ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত করছে, যা দৃশ্যমান হলেও আশানুরূপ বিচার হয়নি। সংশ্লিষ্ট মা-ছেলেকে আমি চিনি না, জানি না। তবে মনে হয় যে, তারা সাধারণ পরিবারের, বিবেকের তাড়নায় খেলার মাঠ রক্ষার্থে প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু তারা সাধারণ পরিবারের না হয়ে যদি কোন হোমরাচোমরা পরিবারের বা সরকারি দলের হতো, তবে তাদের আটক না রেখে বাড়ীতে গিয়ে পুলিশ সালাম দিয়ে আসতো এবং এটাই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বাস্তবরূপ। এ দেশে যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের লোক তাদের জন্য আইন উল্টোপথে চলে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করে যে, যেহেতু সরকার তারাই টিকিয়ে রেখেছে সেহেতু তাদের সকল কর্মই বৈধ এবং তাদের উপরে কথা বলার কেউ নেই।

রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করার আরো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন সাধারণ জনগণের হাতে নেই। বিশ্বব্যাপী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ধনীক শ্রেণী ও গোয়েন্দারা। গোয়েন্দারা রাজা বানায়, রাজা বিদায় করে ক্ষমতা থেকে। কোথাও কোথাও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় বা যেকোন নির্বাচনে মুখরোচক শ্লোগান উঠে সৎ সমাজসেবক ব্যক্তিকে ভোট দাও। কিন্তু ভোটের বাজার বা নমিনেশনের বাজার দখল করে দেশের ধনীক শ্রেণী। পার্লামেন্টে ব্যাংক লুটেরাদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ দায় ভোগ করার দায়িত্ব কার উপরে বর্তায়? ক্ষেত্রমতে দেখা যায়, জনগণ ব্যাংকলুটেরা টাকাওয়ালাদেরই বেশি পছন্দ করে, এর ভিন্নতর অনেক কারণ রয়েছে।

জনগণের একটি ব্যাপক অংশ যেমন দুর্নীতিপরায়ন টাকাওয়ালাদের দাসত্ব করে, তেমনি দলীয় আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চলছে অনুরূপ দাসত্ব। দাসত্বের ভিন্নরূপ হলো তৈলবাজী। রাজনৈতিক দলের কোন মিটিংয়ে দেশের সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে কোন সভায় বক্তাকে যদি সমস্যার উপর বক্তৃতা করতে পাঁচ মিনিট সময় দেয়া হয়, সেখানে নেতাদের গুণগান গাইতেই সময় চলে যায় কমপক্ষে তিন মিনিট। এটা যেন নিয়মে পরিনত হয়েছে। দেশের বাম দল ও ইসলামিক দলগুলোতে তৈলবাজীর অনুরূপ অবস্থা না থাকলেও পৃথিবীর ধনীক শ্রেণী ও গোয়েন্দাদের তাদের প্রতি সমর্থন না থাকার কারণে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে কোন কোন ইস্যুতে বামদল ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেও ইসলামী দলগুলোতে এতোই বিভাজন যে, তারা কোন বিষয়ে কেউ কারো নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার মানসিকতা পোষণ করে না। ইমাম খোমেনী দেশান্তরী থেকেই তার দেশে একক নেতৃত্ব দেখায় মত যে অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন, বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোতে এ অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি।

গোটা পৃথিবীতে পরিবেশ দূষণ হওয়ার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং এ সমস্যার সমাধানের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। বিজ্ঞানীগণ এ মর্মে ভয়াবহ দুযোর্গের আশঙ্কা প্রকাশ করে আগাম বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। অনুরূপ আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ দূষিত হয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নিজ নিজ দলেই গাত্রদাহ বেশি। বড় দলগুলোতে নেতা তোষণ প্রতিযোগিতায় একে অপরকে ল্যাং মারার প্রবণতা অনেক দৃশ্যমান।

স্বভাবজাতভাবেই মানুষ নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলতে চায়। মানুষের স্বভাবে অন্যান্য বিশেষ উপাদানের পাশাপাশি পরশ্রীকাতরতা রয়েছে, রয়েছে আপোষকামিতা। অন্যদিকে মানুষ প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু শাসকদলের সৃষ্ট আইনের বেড়াজাল ও পেটোয়া বাহিনীর তান্ডবের কাছে প্রতিবাদী নাগরিকসমাজ অসহায় হয়ে পড়েছে, ক্ষেত্রমতে সুবিধা ভোগ করছে আপোষকামী ও তেলেরবাটিওয়ালা মানুষগুলি। একটি রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের বেহাল অবস্থা থাকলেই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে ঐ রাষ্ট্র তার নাগরিকদের নিরাপত্তার কতটুকু নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম রয়েছে, তার ওপর? দেখা যায় যে, শাসকগোষ্ঠী, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য যত আইন প্রণীত হয়েছে, সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার জন্য তার একাংশও হয়নি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাগরিকদের প্রতি ক্ষমতা কতটুকু প্রয়োগ করতে পারবে তা সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক দিক নির্দেশনা দেওয়া হলেও প্রশাসনিকভাবে রাষ্ট্র অনুরূপ নির্দেশনা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ লম্বা হাত নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, এদের পৃষ্ঠপোষক ও সুবিধাভোগী সরকার নিজেই।

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দায়বদ্ধতার সঙ্কট
আরও পড়ুন