Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার তাকিদ প্রধানমন্ত্রীর

| প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পানির অপর নাম জীবন। পানি ছাড়া জীবন অচল। বায়ু ও আলোর মতো পানিও জীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। জ্বালানি তেল খুব প্রয়োজনীয় বটে; কিন্তু তা ছাড়াও জীবন চলে। যখন জ্বালানি তেলের ব্যবহার ছিল না তখনো জীবন সচল ছিল। পানি ছাড়া জীবন চলে না, জীবন বাঁচে না। অত্যন্ত উদ্বেগজনক বাস্তবতা এই যে, এখন পানির ব্যাপক সংকট চলছে পৃথিবী জুড়ে। আগামীতে এ সংকট আরো বাড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। মিঠা পানির আধার কমে যাচ্ছে। পানির অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার বাড়ছে। জীবের জীবনধারণের জন্য মিঠা পানি অপরিহার্য। কৃষি, মৎস্য, শিল্প ইত্যাদির জন্যও তার প্রয়োজন অপরিসীম। পানির অধিকার ও দখল নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে, এমন কি একই দেশের বিভিন্ন প্রদেশ বা অংশের মধ্যে বিরোধ চলছে। সংঘাত চলছে কোথাও কোথাও। বলা হচ্ছে, আগামীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে পানি নিয়েই হবে। এহেন পটভূমিতে বিশ্বজুড়ে পানি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা, আলাপ-আলোচনা, সেমিনার-সামিট, সম্মেলন ইত্যাদি হচ্ছে। পানির পরিকল্পিত ও পরিমিত ব্যবহার এবং উন্নত ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে আলাদা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলায় জোর দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার জাপানের কুমানোটোতে অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী চতুর্থ এশিয়া-প্যাসিফিক ওয়াটার সামিটে যে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, তাতে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে অববাহিকাভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণের তাকিদ দিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, বৈশ্বিক পানি পরিকল্পনা ও উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা ছাড়া পানির বর্তমান ও আগামীর সংকট সুরাহার কোনো উপায় নেই।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা যেমন দরকার, তেমনি আঞ্চলিক পর্যায়ে দরকার। প্রতিটি দেশের জন্য জাতীয় পর্যায়েও অত্যাবশ্যক। পানি সংকট একাধারে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। এই তিন পর্যায়ের পরিকল্পনা, কার্যব্যবস্থা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ, কারো অজানা নেই, মিঠা পানির ভাÐার হিসাবে পরিচিত। এত কম জায়গায় এত বেশি মিঠা পানি বিশ্বে আর কোথাও নেই। প্রতি বছর বর্ষকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা ঢলে এখানে বেশুমার পানিরাশির সমাবেশ ঘটে এবং বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় কখনো কখনো। আবার শুল্ক মওসুমে পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নদী শুকিয়ে যায়। সেইসঙ্গে পানির অন্যান্য উৎসও। শুল্ক মওসুমে পানি সংকটের প্রধান কারণ অভিন্ন নদীর উজান থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহার। বাংলাদেশের অর্ধশতের বেশি নদীর পানির উৎস সীমান্তের ওপারে, বিশেষত ভারতে। ভারত ওইসব নদীর উজানে বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে নির্বিচারে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ অভিন্ন নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে উৎসারিত পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। এনিয়ে দেন-দরবার, আলাপ-আলোচনা অনেক হয়েছে, সুফল পাওয়া যায়নি। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ কখনো চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি। তিস্তার পানি চুক্তি ভারতের অনীহায় বছরের পর বছর ঝুলে আছে। অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে তো কোনো কথাই নেই। অভিন্ন নদীর পানির অধিকার এভাবে ভারত কেড়ে নেয়ায় বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পতিত হয়েছে। পানির অভাবে নদী মরে যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে মরু, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততার বিস্তার ঘটছে। কৃষি, শিল্প, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ও জীববৈচিত্র্যের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। মৎস্য চাষ ও নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর আশংকাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এই সামগ্রিক অবস্থাটা বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক, সহজেই অনুমেয়।

বাংলাদেশ মিঠাপানির ভাÐার হলেও পানযোগ্য পানির অভাব ক্রমেই বাড়ছে। এমন অনেক এলাকা আছে যেসব এলাকায় সুপেয় পানির কোনো উৎস নেই, সংস্থান নেই। মাইলের পর মাইল হেঁটে দূরের কোনো উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত জনবসতির কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। দেশের সব এলাকার মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থাসহ কৃষি, শিল্প ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় পানির জোগান নিশ্চিত করা জরুরি। নদনদীসহ মিঠা পানির আধার দখল ও দূষণে ঘোরতর অস্তিত্ব-সংকটে নিপতিত। এই দখল-দূষণ প্রতিহত করতে হবে। সীমান্ত এলাকায়, নদী যেখানে সীমান্ত, সেখানে বাংলাদেশ ভূমি হারাচ্ছে। ভাটি এলাকা বলে নদী বাংলাদেশের দিকে ভাঙছে। প্রায় প্রতিটি সীমান্ত নদী সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ভারত তার এলাকায় বাঁধ দিয়ে সীমানা সংরক্ষণ করলেও বাংলাদেশ তা করতে পারছে না। ‘নদীর মধ্যরেখাই সীমানা’, এই নীতিবলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া নদীর ওপাশ ভারত দখল করে নিচ্ছে। এভাবে এ দেশের ভূমি চলে যাচ্ছে ভারতের গ্রাসে। বদলে যাচ্ছে মানচিত্র। আগামীতে সুপেয় পানির সংকট এবং নানা ক্ষেত্রে মিঠা পানির ব্যবহার বাড়বে। বর্তমানে যেসব সমস্যা দেখা যাচ্ছে তার দ্রæত সমাধান না করা গেলে, সমস্যা-সংকট প্রকট হতে বাধ্য। আমাদের জীবনধারণ, উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবেই, তাতে সন্দেহ নেই। আশংকার এই প্রেক্ষাপটে ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, অভ্যন্তরীণ নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, বর্ষার পানি সংরক্ষণ, আন্তঃসীমান্ত নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা, সীমান্ত নদীসহ সকল নদীর ভাঙন রোধ, নদ-নদীর দখল-দূষণ প্রতিহত এবং পানির পরিমিত ও পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। আমরা জানি, একটি স্থিতিস্থাপক ও সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ তৈরি করা হয়েছে। সেটি এখনো কাগজ-কলমেই আটকে আছে। কাগজ-কলম থেকে বের করে এনে তার বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে পানি নিয়ে দুর্ভাবনার অনেকটাই অবসান হবে বলে অনেকে মনে করেন। বিশ্বের বর্তমান ও আগামীর পানি সংকট মোচনে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ওপর যথাযথ জোর দেয়া হবে বলে আমরা আশা করি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা
আরও পড়ুন