বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সিয়াম সাধনা বা রোজার ধর্মীয় ইতিহাস মহান রুব্বুল আলামীন কোরআনুল কারীমে অত্যন্ত সহজ ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। ইরশাদ হয়েছে : (ক) হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা পরহেজগার হতে পার। (সূরা বাক্বারাহ : ১৮৩)। (খ) অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : রমজান মাস হচ্ছে ঐ মাস যার মাঝে কোরআনুলকারীম নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়েত, পথ প্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী, সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় কিংবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোজা অন্যান্য দিনসমূহে আদায় করবে। আল্লাহপাক তোমাদের আসানী কামনা করেন এবং তোমাদের ওপর কাঠিন্যের আরোপ কামনা করেন না। যেন তোমরা রোজার নির্দিষ্ট পরিমাণকে পরিপূর্ণ করতে পার এবং যাতে করে তোমরা এই হেদায়েত মুতাবেক আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার। (সূরা বাক্বারাহ : ১৮৫)।
উল্লিখিত দু’টি আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে অতিসহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এতে শুধু কেবল রোজার কতিপয় হুকুম আহকামই বর্ণনা করা হয়নি বরং এতে রোজার ধর্মীয় ইতিহাস, রোজার হাকীকত রমজান মাসের বিশেষত্ব এবং রোজার প্রতি আরোপিত অভিযোগসমূহের যথাযথ প্রত্যুত্তরসমূহ বিস্তারিতভাবে ও চিন্তাকর্ষকরূপে তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা রোজার ধর্মীয় ইতিহাসের বিষয়টির সহৃদয় পাঠকও পাঠিকাদের সামনে পেশ করতে প্রয়াস পাব। আসুন, এবার সে দিকে নজর দেয়া যাক।
বস্তুত : কোরআনুল কারীম নাযিলের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর ওপর ঈমান আনয়নকারী মুমিন মুসলমানদের সাথেই রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট এমনটি নয়, বরং কোরআন শরীফ অবর্তীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী নবী রাসূল ও তাদের উম্মতগণের জীবন ব্যবস্থায় ও রোজাকে একটি ধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। পূর্ববর্তী সহীফাসমূহে তাওরাত, যাবুর ও ইঞ্জিল কিতাবেও রোজার ফরযিয়তের কথা বিবৃত আছে।
তাই আল কোরআনে রোজার হুকুম নাযিল হওয়ার পর পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্ধকার যুগের আরবদের সামনে উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, ‘পূর্ববর্তী দুনিয়ার প্রতিটি ধর্ম বিশ্বাসের মাঝে রোজা অবশ্যই ফরজ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত ছিল।’ কিন্তু তৎকালীন আরবের বিরুদ্ধবাদী ও অন্ধকারে নিমজ্জিত অবিশ্বাসী সম্প্রদায় এমন কি বর্তমান যুগের কোনো কোনো তথাকথিত পÐিত ব্যক্তিও মনে করে যে, রাসলূল্লাহ (সা.) প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। (লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ)!
এমতাবস্থায় রাসূলূল্লাহ (সা.)-এর উল্লিখিত দাবি যদি সর্বাংশে সত্যও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয়, তাহলে এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা সংকোচের অবকাশ মোটেই থাকবে না যে, তিনি উপাদান ভিত্তিক জ্ঞান ও মনীষার ঊর্ধলোকে অবশ্যই অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনিই ছিলেন আল্লাহ পাকের সৃষ্ট জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। এই দাবির সত্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের অধিক প্রামাণ্য গ্রন্থ ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার উদ্ধৃতি আমরা পাঠক মহলের সামনে উপস্থাপন করতে যতœবান হব, যা অনুসন্ধানীদের লক্ষ্যস্থলের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে থাকবে।
ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ‘রোজা’ প্রবন্ধের লেখক উল্লেখ করেছেন যে, ‘রোজার বিধি বিধান ও আদায় পদ্ধতি, আবহাওয়া সামাজিক ব্যবস্থা এবং সভ্যতা বিবর্তনের দরুন যদিও বিভিন্নরূপ পরিদৃষ্ট হয়, তথাপিও আমরা অতিকষ্টে এমন কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মের নাম উপস্থাপন করতে পারব না। যেখানে রোজাকে ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়নি।’ সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, ‘বস্তুত: রোজা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সর্বস্থলেই স্বীকৃত ছিল এবং আছে।’
ভারতবর্ষকে ধর্ম বিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থল হিসেবে মনে করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, রোজা থেকে এখানকার ধর্মগুলো ও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে প্রতি মাসের এগারো ও বারো তারিখে ব্রাহ্মণদের ওপর একাদশীর রোজা অপরিহার্য ছিল। এই হিসাব অনুসারে বারোমাসে সর্বমোট চব্বিশটি রোজা পাওয়া যায়। কোনো কোনো ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবার রোজা ব্রত পালন করে। হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে। তাছাড়া জৈন ধর্মের মাঝে রোজা পালনের শর্তাবলি অত্যন্ত কঠোর।
তাদের মতানুসারে চল্লিশদিন পর্যন্ত একটি রোজা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দক্ষিণাত্যে প্রতি বছর কোনো কোনো ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবত রোজা ব্রত পালন করে। প্রাচীন মিশরীয়দের মাঝে ও রোজা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। গ্রীক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা রোজা রাখত। পার্শীয়ান ধর্মে ও রোজার হুকুম প্রযোজ্য ছিল। আর ইহুদীদের মাঝে ও রোজা ছিল আল্লাহর আরোপিত ফরজ ইবাদত। হযরত মূসা (আ.) কোহেতুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত রোজা রেখেছিলেন।
খৃস্টান ধর্মে বর্তমান কালেও রোজার প্রভাব বিদ্যমান। হযরত ঈসা (আ.) চল্লিশদিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোজা রেখেছেন। আরববাসীরাও ইসলাম আগমনের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিফহাল ছিল। উপরোক্ত বিশ্লেষণ দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে কোরআনুল কারীমের নির্দেশ ‘তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরজ করা হয়েছিল’ এই বাণী কতখানি ঐতিহাসিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।