দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
সিয়াম সাধনা ও আত্মশুদ্ধির বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে এলো পবিত্র রমজান মাস। হিজরি বর্ষের বারো মাসের মধ্যে নবম মাস হলো রমজান। ফযিলত, রহমত, বরকতের দিক দিয়ে এ মাস অন্য ১১ মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ধর্মপ্রাণ মুসলানদের কাছে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
ফযিলতের দিক থেকে রমজান মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাসের প্রথমাংশে রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত আর তৃতীয়াংশে নাজাত তথা দোজখ থেকে মুক্তি।’ তৃতীয়াংশে- অর্থাৎ শেষ দশকে রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ‘লাইলাতুল কদর’। আল্লাহ তা’লা উম্মতে মুহাম্মাদির লাইলাতুল কদরের একরাত্রির ইবাদতকে পূর্ববর্তী উম্মতগণের এক হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ রাত সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘শবে কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ’।
‘সাওম’ বা রোজা ইসলামের মূল ভিত্তিসমুহের মধ্যে অন্যতম। ‘সাওম’ আরবি শব্দ। এর অর্থ বিরত থাকা। ‘সাওম’ শব্দের বহুবচন হচ্ছে ‘সিয়াম’। শরিয়তের পরিভাষায় সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার ও যৌনাচার থেকে বিরত থাকার নাম ‘সাওম’। আল্লাহ তা’লা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর ‘সিয়াম’- তথা রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পারো’। (সূরা বাকারা- ১৮৩)।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সৎ পথের ¯পষ্ঠ নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এই মাসটি পাবে, সে এতে রোজা রাখবে।’ (সূরা বাকারা ১৮৫)।
রমজান মাসের আগমন হলে রাসূলুল্লাহ (সা.) খুবই আনন্দিত হতেন। সাহাবায়ে কেরামদের বলতেন, বরকতময় মাস রমজান এসেছে। এ মাসের কিছু ফযীলত বর্ণনা করে তিনি বলতেন, ‘আল্লাহ তা’লা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। (নাসায়ি)।
রাসুল (সা.) বলেছেন, রমজান মাসে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ নিয়ামত দান করা হয়েছে, যা আগেকার উম্মতগণকে দেওয়া হয়নি। এই নিয়ামতগুলো হচ্ছে- ১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়ে বেশী ঘ্রানযুক্ত। ২. ইফতার পর্যন্ত রোজাদারের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন। ৩. রোজাদারের জন্য প্রতিদিন জান্নাতকে সজ্জিত করা হয়। ৪. শয়তানকে বন্দি করা হয়। ৫. রমজানের শেষ রাতে সকল উম্মতকে ক্ষমা করা হয়।
আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য অধিক পূণ্য অর্জনের বিশেষ অফার নিয়ে আসে পবিত্র রমজান মাস। আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘নিশ্চয়ই রোজা আমার জন্য, এর প্রতিদান আমিই দান করি’। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘রমজান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করল’। (বায়হাকি)।
এ মাসে সিয়াম পালনকারী একজন মুসলমান সত্যিকারের খাঁটি ইবাদতকারী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ঠ হয়ে পাপি-তাপি বান্দাদেরকে উদারচিত্তে ক্ষমা করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসে সওম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি)।
রমজান মাসের প্রত্যেকটি রোজা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন কারণ ছাড়া ইচ্ছাপূর্বক রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করে সে যদি অন্য সময় সারা জীবন রোজা রাখে তবুও রমজানের একটি রোজার সমতুল্য হবে না।’ একশ্রেণীর মানুষ আছে যারা পাপিষ্ঠ শয়তানের ধোকায় পড়ে শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া গোপনে সিযাম ভঙ্গ করে ফেলে। সবার মনে রাখা উচিৎ- নিজের প্রতিটি কাজের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ঘরের দরজা বন্ধ করে বা নির্জন স্থানে অবস্থান করলে হয়তো দুনিয়ার মানুষকে আড়াল করা যাবে; কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালাকে আড়াল করা সম্ভব নয়। তিনি সবকিছু দেখেন, সবকিছু শুনেন। পৃথিবীর সব কিছুই তাঁর দৃষ্টিসীমার মধ্যে। কোন কারণ ছাড়া মাহে রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করলে আল্লাহর দরবারে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
আবার অনেকে রোজা রেখে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হন। নানাবিধ গোনাহের কাজে লিপ্ত হন। এরকম সিয়াম পালনের দ্বারা আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জিত হবে না। খানাপিনা, যৌনাচার থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার নামই হচ্ছে ‘সিয়াম’। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও মিথ্যা আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারি)।
এ মাসে প্রত্যেক মুসলমানের করণীয় হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম পালন করা। অন্যান্য ফরজ ইবাদাতসমুহ গুরুত্বসহকারে আদায় করা। সুন্নাত ও যাবতীয় নফল ইবাদাত পালনে যত্নবান হওযা। বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। তাওবা-ইস্তেগফার, জিকির-আজকার ও মোনাজাত করা। হালাল গ্রহন করা হারাম থেকে থেকে বেঁচে থাকা। কাউকে গালি না দেওয়া। গীবত না করা। চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি না করা। সন্ত্রাস, খুন, গুম, ধর্ষণ, যেনা-ব্যবিচার না করা।
রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করা প্রত্যেকের জন্য জরুরী। এ মাসে যাবতীয় অশ্লিলতা ও ব্যহায়াপনা থেকে বেঁচে থাকা, দিনের বেলা হোটেল রেস্তেরা বন্ধ রাখা উচিত। সেহরী, ইফতার ও তারাবিহের সময় যাতে বিদ্যুৎবিভ্রাট বা লোডশেডিং না হয় সে দিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বোগতি রোধ করে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখতে পাই, বিভিন্ন আরব দেশে রমজান মাস আসার আগেই পণ্যের দাম অনেকটা কমিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন দেশে মূল্য ছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এর ঠিক উল্টো। এখানে রমজান মাস আসার আগেই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হযে যায়। এছাড়াও পণ্যে ভেজাল দিয়ে আমাদের খাবারকে দুষিত করা হচ্ছে। ভেজাল খাবার গ্রহণের ফলে মানবদেহে বিভিন্ন ধরণের রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে অসৎ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অপকৌশলের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে।
বছরের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র রমজান মাস এলে ধর্মপ্রান মুসলমানরা আনন্দিত হন। প্রত্যেকেই দুনিয়াবি কাজকর্ম সংক্ষিপ্ত পর্যায়ে নিয়ে আসেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, আফিস-আদালত ইত্যাদির সময়ও সংক্ষিপ্ত করা হয়। সকলেই তাক্বওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধির জন্য আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগীতে মশগুল হন। বাংলাদেশের মানুষ অধিক ধর্মপরায়ন। এ দেশের মানুষ ইবাদাতের বিশেষ উপলক্ষ্যগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগানোর প্রয়াস চালায়। বিশেষকরে রমজান মাস এলে এদেশের মুসলমানরা আল্লাহর বন্দেগীতে আত্মনিয়োগ করে। মসজিদগুলো মুসল্লিদের উপস্থিতিতে কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে চলতে থাকে খতম তারাবিহ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বৈশি^ক মহামারী করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গতবারের ন্যায় এবারও মুসল্লিদের জন্য মসজিদ পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশেষ নির্দেশনার ভিত্তিতে মসজিদে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে বলা যায়Ñ খুব কমসংখ্যক মানুষ এবার মসজিদে গিয়ে ইবাদাত-বন্দেগীর সুযোগ পাবেন। এমতাবস্থায় ধর্মপ্রান মুসলমানগণকে ঘরে বসেই এবাদাত-বন্দেগী করতে হবে।
পবিত্র রমজান মাসে মুমিনরা আশাবাদী, আল্লাহপাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র রমজান মাসের রহমত, বরকত ও মাগফেরাতের বদৌলতে দুনিয়াবাসীকে ‘করোনাভাইরাস’ মাহামারী থেকে মুক্ত করবেন। অফুরন্ত রহমত দিয়ে পৃথিবীকে গজবমুক্ত করবেন। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন!
লেখক : শিক্ষক, জামেয়া আওয়ারে মদিনা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর সিলেট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।