পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওর অঞ্চলের নদনদীতে হঠাৎ পানি বাড়তে শুরু করেছে। উজানের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাত এর কারণ। পাহাড়ি ঢল নদনদী উপচে ইতোমধ্যে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, মধ্যনগর এবং নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঢুকে পড়েছে। পানির তোড়ে বাঁধে ভাঙন বা ফাটল দেখা দিয়েছে। তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি প্রবেশ করেছে। এই উপজেলা ও মধ্যনগর উপজেলার ৫ হাজার হেক্টর বোরো ধান এখন ডুবতে শুরু করেছে। এদিকে খালিয়াজুরী উপজেলার মন নদে পানি বাড়ায় অন্তত দু’ হাজার হেক্টর বোরো ধান ডুবে গেছে। আগামীতে আরো কয়েকদিন উজানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। সে কারণে ঢলও অব্যাহত ও জোরদার হতে পারে। অসময়ের এই ঢলে হাওর অঞ্চলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। কৃষকরা ভয়ে-আতংকে দিশাহারা অবস্থায় পতিত হয়েছে। এখন বোরো ধান ওঠার সময়। পাকতে শুরু করেছে। আর ১০-১২ দিনের মধ্যে কাটা যাবে। হাওর অঞ্চলের কৃষকরা এতদিন এই আশায় দিন গুনেছে যে, ধান কেটে ঘরে তুলবে, যাতে বছরের খোরাকের সংস্থান হবে ও অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ হবে। হাওর অঞ্চলে একবারই ধান হয় এবং সেটা এই বোরো। বোরো ধানের ওপরই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-সংসার নির্ভর করে। সেই ধান যদি হারানোর আশংকা দেখা দেয় তবে উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার কোনো শেষ থাকে না। ক’বছর আগে প্রবল পাহাড়ি ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা প্রভৃতি জেলার হাওর অঞ্চলে বোরো ধান সম্পূর্ণ তলিয়ে যায়। কৃষকরা হয়ে পড়ে সর্বস্বান্ত। গোটা হাওর অঞ্চলে একটা অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যখনই উজানে আগাম বৃষ্টি হয় এবং ঢল নেমে আসে, তখনই হাওর অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সব হারানোর ভীতি দেখা দেয়। বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢলের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রাকৃতিক কারণে আমরা ভাটিতে। উজানে বৃষ্টি হলে ঢল আকারে তা ভাটিতে নেমে আসবেই। এটাই স্বাভাবিক। ঢল বা বন্যা থেকে ফসল, ঘরবাড়ি ও সহায়সম্পদ রক্ষায় হাওর অঞ্চলজুড়ে তাই বহু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধ ফসলের রক্ষাকবচ।
হাওর অঞ্চলে সর্বশেষ সবচেয়ে বড় ধরনের ফসলহানির পর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও তদারকি জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতি বছরই এ উপলক্ষে বাজেট নির্ধারণ করা হয় এবং কাজ করা হয়। কিন্তু কাজের সময় ও মান ঠিক থাকে না। এ ব্যাপারে প্রতিবছরই নানা অভিযোগ ওঠে। এবারও অভিযোগ আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র মতে, এবার সুনামগঞ্জের হাওরে ৭২৭টি প্রকল্পের ১২১ কোটি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হওয়ার কথা। বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। অথচ, এখনো শেষ হয়নি। দেখা গেছে, বাঁধের বিভিন্ন স্থানে মাটি নরম, কোথাও ফাটল, কোথাও চিড় ধরেছে। বাঁধে ঘাষ লাগানোর কথা থাকলেও অনেক স্থানেই ঘাষ নেই। এধরনের বাঁধ কীভাবে ফসল রক্ষা করবে, তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্থানীয় কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। তারা বাঁধের ব্যাপারে ভরসা দিলেও মানুষ সে ভরসায় আস্থা রাখতে পারছে না। বলা বাহুল্য, সুনামগঞ্জের বাঁধের এই চিত্রের সঙ্গে অন্যান্য জেলার বাঁধের চিত্রের কোনো ফারাক নেই। যদি বাঁধ যথাসময়ে যথাযথভাবে তৈরি করা হতো, মেরামত বা সংস্কার করা হতো, তাহলে ফসল রক্ষা নিয়ে এতটা ভাবতে হতো না, উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হতো না। একবার-দু’বার নয়, বহুবারই বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, বাঁধ নির্মাণ-মেরামত ঠিক সময়ে করতে হবে, মানসম্পন্নভাবে করতে হবে। কিন্তু এই দুটি কথার একটিও রাখা হয় না বা হয়নি। ফলে প্রতিবছর কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় হয়ে গেলেও সুফল হাতের নাগালে আসছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের ব্যাপারে একটা গুরুতর অভিযোগ এই যে, তার কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট একসূত্রে বাঁধা। কাজ ঠিক সময়ে ঠিকমত হচ্ছে কিনা, মানম্পন্নভাবে হচ্ছে কিনা, তা নিয়মিত দেখভাল করা একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনেও পানি-উন্নয়ন বোর্ড বেখেয়াল এবং সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। এখানেও সেটা হলে আজ ভঙ্গুর ও দুর্বল বাঁধের কবলে পড়তে হতো না। এখন বাঁধ ঠেকানোর জন্য কোনো কোনো স্থানে বাঁশ দিয়ে বেড়া কিংবা বালির বস্তা বসানো হচ্ছে। এতে শেষ পর্যন্ত বাঁধ রক্ষা হবে কিনা, কারো পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। পাহাড়ি ঢলে ফলস ডুবে যাওয়া হাওর অঞ্চলে কোনো নতুন ঘটনা নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাই উচিত ছিল, বিষয়টি স্মরণ রেখে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করা এবং বাঁধের যাবতীয় কাজ আগেই শেষ করা। হাওর অঞ্চল আমাদের খাদ্যশস্যের একটা বিশাল ভাণ্ডার। এই অঞ্চলের ধানের ওপর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং, খাদ্যশস্যের এটিসহ সকল উৎস সুরক্ষা করাকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসাবে গণ্য করা উচিত। জানা গেছে, এবার সুনামগঞ্জের হাওরসহ গোটা জেলার প্রায় ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ টন। এই গোটা আবাদ-উৎপাদন এখন হুমকিতে। হুমকিতে অন্যান্য হাওরের আবাদ-উৎপাদনও। এ হুমকি থেকে ফসল রক্ষা করতে হবে। ঘরে তুলতে হবে ভালোয় ভালোয়। এজন্য বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতির দিকে যেমন নজর রাখতে হবে, তেমনি ভাঙন থেকে, ছিদ্র থেকে বাঁধ রক্ষা করতে হবে। আর ধান পাকলে যত দ্রুত সম্ভব কেটে ঘরে তুলতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।