পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
লেখা শুরু করেছি রবিবার ৩ এপ্রিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি এখন পাকিস্তানের ওপর নিবদ্ধ। আজ রবিবার পাকিস্তান সময় বেলা ১১টায় অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধী দলসমূহের অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করার কথা। বেলা ১টা পর্যন্ত আমি বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরাসহ একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল দেখলাম। আমার কম্পিউটারে পাকিস্তানের ‘ট্রিবিউন’সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দৈনিকের অনলাইন সংস্করণ দেখলাম। দেখলাম, পাকিস্তান সময় বেলা ১১টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরিবর্তে পাক পার্লামেন্টের স্পিকার আসাদ কায়সারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলসমূহ অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করছে। পাকিস্তানের সংবিধান এবং সংসদীয় কার্যবিধি মোতাবেক এই অনাস্থা প্রস্তাব তাদের জাতীয় পরিষদের (পার্লামেন্ট) সমস্ত সদস্যের মধ্যে সার্কুলেট করতে হবে এবং ৭ দিনের মধ্যে প্রস্তাবটির ওপর ভোটাভুটি হবে। প্রস্তাবে অভিযোগ করা হয় যে, স্পিকার নগ্নভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করছেন।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, রাশিয়ার ইউক্রেন হামলাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দটি হলো ঈধহহড়ঃ নব পড়হফড়হবফ অর্থাৎ ক্ষমা করা যায় না। ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অবস্থানের সাথে সেনাপ্রধান কামার বাজওয়ার অবস্থান সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইমরান সরকার জাতিসংঘে ইউক্রেন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত ছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান কামার বাজওয়ার বক্তব্যের ব্যাখ্যা হলো প্রস্তাবের পক্ষে। অর্থাৎ রুশ আগ্রাসনের নিন্দার পক্ষে পাকিস্তানের ভোট দেওয়া উচিৎ ছিল। অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের দিন অর্থাৎ ৩ এপ্রিল রবিবার সেনাপ্রধান কামার বাজওয়া বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীরসহ ভারতের সাথে সব বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, কাশ্মীরসহ সব সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক আলোচনাতেই বিশ্বাসী ইসলামাবাদ। তিনি আরো বলেন, ভারত যদি এই প্রস্তাবে রাজি হয় তাহলে পাকিস্তান এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। তিনি উল্লেখ করেন, কাশ্মীর বিরোধ ছাড়াও ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ চলছে। পাকিস্তানের জন্য এটি তো উদ্বেগের বিষয়। আমরা চাই, আলোচনার মাধ্যমে এবং কূটনৈতিক পথেই এই বিরোধের নিষ্পত্তি হোক।
ভারতের সাথে বিরোধ বলুন, কাশ্মীর বিরোধ বলুন অথবা চীন-ভারত বিরোধ বলুন- এগুলো সব হলো সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয়। এসব বিষয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেনাপ্রধানকে এসব বিষয়ে সাধারণত কথা বলতে দেখা যায় না। উপরন্তু সেনাপ্রধান কাশ্মীর, ভারত এবং চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা ইমরান সরকারের নীতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। বরং বলা যায়, সাংঘর্ষিক। কামার বাজওয়ার বক্তব্য বরং দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে মার্কিন নীতির সাথে সংগতিপূর্ণ। ভারত বিভক্তির পর জাতিসংঘ একবার নয়, একাধিকবার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল যে, জাতিসংঘের মাধ্যমে কাশ্মীরে গণভোট হবে। ঐ গণভোটেই সিদ্ধান্ত হবে, কাশ্মীর ভারতে যাবে, নাকি পাকিস্তানে যাবে, নাকি স্বাধীন থাকবে। জাতিসংঘ নিরাপাত্তা পরিষদের প্রস্তাবসমূহের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে ভারত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ভারত। তার দুইবার কাশ্মীর নিয়ে। একবার বাংলাদেশ নিয়ে। কাশ্মীরের ৯০ শতাংশ মানুষ পাকিস্তানে যোগ দিতে চায়। কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে, সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভারত কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশের বেশি দখল করে আছে। কাশ্মীর নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু আজ ৭৫ বছর হলো ভারত ৪ লক্ষ সৈন্যের উদ্যত সঙ্গীতের মাথায় কাশ্মীরের সিংহভাগ মানুষের বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। তারপরেও জেনারেল কামার বাজওয়া কোন রহস্যময় কারণে কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাশা করেন? কোন রহস্যময় কারণে তার শান্তির এই লোলিত বাণী ভারতের ‘আনন্দবাজার গ্রুপ’ এবং হিন্দুত্ববাদী গ্রুপ লুফে নেয়?
॥দুই॥
লেখার এই পর্যায়, অর্থাৎ রবিবার বেলা ২:১০ মিনিট। পাকিস্তানের ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ পত্রিকার শিরোনাম ভেসে উঠলো আমার কম্পিউটারে। লেখা হয়েছে, ‘অনাস্থা প্রস্তাব ডিসমিসড। পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট আলভির নিকট প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সুপারিশ।’ বেলা তিনটার খবর: প্রেসিডেন্ট আলভি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুমোদন করেছেন। জাতীয় পরিষদ (বাংলাদেশে বলা হয় জাতীয় সংসদ) ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এসম্পর্কিত গেজেট নোটিফিকেশন জারি হয়েছে। ইতোমধ্যে ইমরান খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও এবং টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছেন এবং দেশের সাধারণ জনগণকে সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ধারণা করা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক জটিলতা এবং সাংবিধানিক সংকট শেষ হয়ে গেল। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র মোতাবেক কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সন্ধ্যার ‘এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে’ দেখলাম একটি নতুন খবর। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমেরিকার ‘নিউ ইয়র্ক টাইমসের’ সাথে পার্টনারশিপ করে পাকিস্তানের তিনটি মহানগর থেকে একযোগে এক্সপ্রেস ট্রিবিউন প্রকাশিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকাটি মার্কিন ও পাশ্চাত্য ঘেঁষা। তবে পাকিস্তানের সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষের খবরই এই ইংরেজি দৈনিকটিতে পাওয়া যায়। যাই হোক, অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করার এবং জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিরোধী দলসমূহ রবিবারেই পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। রবিবার দিন পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের সাপ্তাহিক ছুটি। তৎসত্ত্বেও বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে সুপ্রিমকোর্ট মামলাটি আমলে নিয়েছে। এর আইনী অর্থ এই যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংকট শেষ হয়েও শেষ হয়নি। এখন সুপ্রিমকোর্টের রায়ই হবে এই সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকটের শেষ কথা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্রে, প্রেসিডেন্টের পদটি একটি অলংকারিক পদ। তৎসত্ত্বেও তিনি যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান, তাই তিনি রাষ্ট্রের প্রতীক এবং সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। একারণে প্রথা (ঈড়হাবহঃরড়হ) মোতাবেক, কর্মরত অর্থাৎ সিটিং প্রেসিডেন্টের কোনো কাজ বা পদক্ষেপকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও চ্যালেঞ্জ বা নাকচ করতে পারে না বা করে না। পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে যে, প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপ অর্থাৎ সংসদ ভেঙ্গে দেওয়াকেও পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট তার বিচারিক ক্ষমতার এখতিয়ারের মধ্যে এনেছে। সোমবার অর্থাৎ ৪ এপ্রিল দুপুরের মধ্যেই এই লেখাটি ছাপার জন্য প্রেসে চলে যাবে। তাই শেষ কথা জানার সুযোগ আমার হলো না।
পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট যদি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সংসদ ভেঙ্গে দেওয়াকে অসাংবিধানিক বা শাসনতন্ত্র বিরোধী বলে রায় দেয় তাহলে সেটিও এক বিরাট শাসনতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি করবে। সংবিধানে রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সংসদ বাতিল করবেন এবং নির্ধারিত সময়ের আগেই সংসদ বাতিল করার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। এখন যদি সুপ্রিমকোর্ট প্রেসিডেন্টের নির্দেশকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে তাহলে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট পুনর্বহাল হবে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকার/ডেপুটি স্পিকারের পদক্ষেপ অবৈধ বলে গণ্য হবে।
॥তিন॥
যেহেতু সাংবিধানিক বা আইনগত সংকটের চূড়ান্ত সমাধান সম্পর্কে কিছু বলার সময় আমার হাতে নাই (কারণ লেখাটি শেষ করতে হচ্ছে রবিবার রাতে) তাই বিষয়টির এখানেই ইতি টানছি। যদি পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট পার্লামেন্ট ভাঙ্গার নির্দেশকে অবৈধ ঘোষণা করে তাহলে দেশটিতে যে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে, সেটি হবে ভয়াবহ। কল্পনাও করা যায় না সেই সংকটের ভয়াবহতার মাত্রা। একটি সরকারের প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী- এক কথায় সমগ্র সরকার বলছে যে, একটি বিদেশি রাষ্ট্র সরকারকে অপসারণের জন্য বিরোধী দলকে মিলিয়নস অব ডলার ঘুষ দিয়েছে।
গত রবিবার সন্ধ্যায় নতুন কতগুলি ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। বিরোধী দলীয় সদস্যরা সমবেত হয়ে পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পাক জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলীয় নেতা পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ছোটভাই শাহবাজ শরীফকে তাদের সংসদীয় দলের নেতা এবং পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তারা সংসদের নতুন স্পিকারও নির্বাচিত করেছেন। শাহবাজ শরীফ নির্দেশ দিয়েছেন যে, এখন থেকে প্রশাসন যেন তাঁর কথা ছাড়া আর কারো নির্দেশ না মানে। এই সমগ্র প্রক্রিয়াই হাস্যকর। প্রেসিডেন্ট ছাড়া কেউ সংসদের অধিবেশন ডাকতে পারে না। আর আনুষ্ঠানিক অধিবেশন ছাড়া স্পিকার বা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা যায় না।
ঐদিকে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিয়েছেন, সোমবার ৪ এপ্রিল অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ ও জাতীয় পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিরোধী দল যে মামলা করেছেন, ৫ সদস্যের ফুল বেঞ্চে সোমবার ৪ এপ্রিল তার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এতক্ষণে, অর্থাৎ রবিাবর দিবাগত রাতের মধ্যে সরকারের কোনো ব্রাঞ্চ বা শাখা যেন সংবিধান বহির্ভূত কোনো কাজ না করে। সুপ্রিম কোর্ট সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। কারণ, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল আশঙ্কা করছিলেন যে, রাতের মধ্যেই সেনাবাহিনী ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে পারে। অর্থাৎ ক্ষমতা দখল করতে পারে।
কারণ, ইমরান খান যেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে অভিযোগ করেছেন যে, তাকে অপসারণের জন্য আমেরিকা অঢেল অর্থ ছিটিয়েছে, বিরোধী দলের সংখ্যা ভারী করার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সংসদ সদস্য ক্রয় করেছে, সেখানে ৩ এপ্রিল ‘ডেইলি স্টারের’ খবর মোতাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া মার্কিনীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।
বিগত ৭০ বছর ধরে আমেরিকা এবং সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সর্বনাশ করেছে। ইমরান খান মার্কিন রক্তচক্ষু এবং সেনাবাহিনীর চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জনতার আদালতে গিয়েছেন। এখন দেখতে হবে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং বিদেশি দালালদের বিরুদ্ধে ইমরানের জীবন-মরণ সংগ্রামে কোন পক্ষ জয়ী হয়। দালালদের ইমরান বলেছেন মীর জাফর এবং মীর সাদিক। ইমরান আরো বলেছেন, আল্লাহ ওপর থেকে সব দেখছেন।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।