Inqilab Logo

রোববার, ২৩ জুন ২০২৪, ০৯ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনোত্তর বিক্ষোভ

প্রকাশের সময় : ১২ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অভাবনীয়-অপ্রত্যাশিত ফলাফলে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই সেখানকার নাগরিক সমাজে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ট্রাম্পের শহর নিউ ইয়র্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্টেটে ও শহরে ট্রাম্পবিরোধী গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক, সানফ্রান্সিসকো, অরেগন, শিকাগো, ক্যালিফোর্নিয়া, সিয়াটল, পিসবার্গ, পোর্টল্যান্ড, পেনসিলভানিয়া, ওয়াশিংটনসহ আরো অনেক শহরে ট্রাম্পবিরোধী গণবিক্ষোভে হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় বেরিয়ে আসার খবর পাওয়া গেছে। গণতন্ত্র ও নির্বাচনী শৃঙ্খলায় দুইশতাধিক বছরের ধারাবাহিক ঐতিহ্য ও অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই গর্ববোধ করে থাকে। নির্বাচন যেমনই হোক, ফলাফল চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রতিপক্ষ প্রার্থীর পক্ষ থেকে ফলাফল মেনে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীর প্রতি অভিনন্দন বার্তা পাঠানোর রেওয়াজে এবারো ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রার্থিতা মনোনয়ন ও প্রচারণার শুরু থেকেই ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে টপ ফেবারিট ও সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখা হয়েছিল। মার্কিন নির্বাচনের ট্রাডিশন অনুসারে নানা ধরনের জনমত জরিপে উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন হিলারি। ট্রাম্পের অনেক বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্যের কারণে সচেতন মার্কিন নাগরিক সমাজ ট্রাম্পকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চাননি। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ট্রাম্পের কিছু বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এরপরও ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার সাথে সাথেই হিলারি ক্লিনটন তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। একইভাবে বারাক ওবামাও তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাম্পের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন এবং তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ওবামার এবং ‘প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট’ ট্রাম্পের সৌজন্য সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়েছে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে।
নির্বাচনে জয়-পরাজয় অতি সাধারণ ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগে প্রায় আড়াইশ’ বছরের মার্কিন ইতিহাসে কোন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এভাবে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখানোর নজির নেই। নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিগত, বর্ণবাদী ও ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে খ-িত বা শ্বেতাঙ্গ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ শতকরা ৬৯ ভাগ শ্বেতাঙ্গ নাগরিকের ভোট টানতে ট্রাম্পের সেই নির্বাচনী ট্রাম্পকার্ড যে কাজে লেগেছে তা তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাস, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নে সাংবিধানিক সাম্যনীতি ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে ওঠার ইতিহাসের সাথে বহুত্ববাদের যে অসামান্য ভূমিকা ছিল তা’ বিস্মৃত হওয়ার বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে মূলত ইমিগ্রান্ট বা অভিবাসীদের দেশ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে মাল্টি কালচারালিজম ও অভিবাসীদের অসামান্য ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সূচিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ও সামাজিকভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, মন্দার শিকার হয়েছে সেই কঠিন বাস্তবতা থেকে দেশকে বের করে আনতে মার্কিন ইতিহাসের প্রথম একজন আফ্রো-আমেরিকান বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্ব অনেকটাই সফল হয়েছে। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন ইতিহাসের গভীর সত্যকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র সংকীর্ণ বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল গ্রহণ করায় তার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীন ও নিরাপত্তাহীন বোধ করছেন সেখানকার লাখ লাখ মানুষ। তারাই মার্কিন গণতন্ত্রের শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে এসেছেন। লাখ লাখ মানুষ ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে না পারার এই বাস্তবতা মার্কিন গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি অশনি সংকেত।
নির্বাচন আর রাষ্ট্র পরিচালনা এক কথা নয়। নির্বাচনের মাঠে যত কথাই বলা হোক, তার সবকিছুর বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব হয় না। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই সুর পাল্টে ফেলেছেন। তিনি এখন সকল আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হতে চান। সকলকে নিয়ে কাজ করতে চান, এমনকি প্রেসিডেন্ট ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে এতদিন যে সব আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছিলেন তার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তিনি উভয়েরই প্রশংসা করেছেন। দেশের জন্য তাদের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি ট্রাম্পের নির্বাচনী ওয়েবসাইট থেকে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্যও প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। মার্কিন নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত ফলাফলের পরও প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের প্রতিক্রিয়া ও ইতিবাচক আচরণ থেকে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অনেক শিক্ষণীয় আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষকরা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ বলে উল্লেখ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ইমিগ্রান্টদের দেশে সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক সমঝোতা ছাড়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কল্পনাও করা যায় না। ইসলামোফোবিয়া ষড়যন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে মুসলমানদের টার্গেট করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরো অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। বর্ণবাদী ও সংকীর্ণ জাতিগত দৃষ্টিভঙ্গী নির্ভর নির্বাচনী প্রচারণার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল যাই হোক, এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ট্রাম্পবিরোধী গণবিক্ষোভ চলছে। ইমিগ্রান্ট, মুসলমান, হিস্পানিক, মেক্সিকানদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সংগঠন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্য ও জাতীয় সংহতির বিরুদ্ধে এটি অনেক বড় হুমকি ও নেতিবাচক দৃষ্টান্ত। এ ক্ষেত্রে ‘টুগেদার স্ট্রংগার’ নীতি গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। পুঁজি ও তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্বায়নের এই যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তির একদেশদর্শী ভূমিকার কোন সুযোগ নেই। বিশ্বসম্প্রদায়ের আশঙ্কা এবং মার্কিনীদের বিক্ষোভ প্রশমনে নতুন মার্কিন নেতৃত্বকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনোত্তর বিক্ষোভ
আরও পড়ুন