Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রান্তিক মানুষের দিকে নজর দিতে হবে

মো. মাঈনউদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০২২, ১২:০৬ এএম

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। জিডিপি বেড়েছে, মাথা পিছু আয় বেড়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটছে। এসব কিছুর মাঝে প্রান্তিক জনগণ কি ভালো আছে? তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমেছে না বেড়েছে? গত বছর থেকে আজকের বছর কেমন যাচ্ছে, গতকালের চেয়ে আজকের দিন কেমন যাচ্ছে তা দেখা উচিত। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি মানুষের সঞ্চয়ের উপর প্রভাব ফেলছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর উন্নয়ন মানে তো শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়। আমরা কত টাকা আয় করলাম, কতটা বাড়ি বানালাম, কয়টি গাড়ি কিনলাম, কত টাকা ব্যাংকে রাখলাম- এগুলো উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন মানে হলো, আমাদের দৈনন্দিন জীবন প্রফুল্ল কিনা, আমদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক কিনা, আমরা কীভাবে কথা বলি, কীভাবে সবাইকে সম্পৃক্ত করি, আমাদের চলাফেরার ধরন কেমন, কীভাবে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাব এইসব। ১০ বছর আগে আমরা কেমন ছিলাম তা না ভেবে আমি বলব আজকে আমরা কেমন আছি তা দেখা উচিত। মানুষের জীবনযাত্রার মান তখন উন্নত হয়, যখন ব্যয় বৃদ্ধির চেয়ে আয় বেশি হারে বাড়ে। তখন নিত্যপণ্য স্বাচ্ছন্দে কেনার পর মানুষ বিনোদন, শিক্ষা ও চিকিৎসায় ব্যয় করতে পারে। ভালো বাসায় থাকতে পারে। ভালো মানের জামা কাপড় ও পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত মজুরির হার সূচক বেড়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ। আর মূল্য সূচক বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। অন্যদিকে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)’র হিসাব মতে, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৯৫ শতাংশ। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৯২ শতাংশ। বিশ^ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৬৪০ ডলার (ক্রয়ক্ষমতা সক্ষমতার ভিত্তিতে- পিপিপি), যা ২০২০ সালে ৫ হাজার ৩১০ ডলারে উন্নীত হয়। এতে বৃদ্ধির হার ১০১ শতাংশ। কিন্তু মাথাপিছু আয় দিয়ে জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পেয়েছে বলা যাবে না। কারণ, দরিদ্রদের আয় কমে যাওয়ার বিপরীতে ধনীদের আয় বৃদ্ধি পেলে গড় হিসাবে মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। কিন্তু তাতে বৈষম্যের চিত্রটি আসে না।

করোনাকালে বেসরকারি সংস্থাগুলোর জরিপ অনুসারে, দারিদ্রের হার ছিল ৪১ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে দেখা যায়, ২০১০ সালে দেশের দারিদ্রের হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। করোনার আগে তা কমে ২১ শতাংশে নামে। করোনাকরোনা পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের উপরে বেশি চাপ পড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের মতে, মূল্যস্ফীতি যেটা হয়েছে তার কারণে প্রকৃত মজুরি বাড়েনি। তিনি বলেন, মজুরি সূচক হিসাব করা হয় ভিত্তি বছর ২০১০-১১ ধরে। আয় মূল্য¯ফীতি হিসাব করা হয় ২০০৪-০৫ ভিত্তি বছর ধরে। মূল্য¯ফীতির ক্ষেত্রেও ২০১০-১১ ভিত্তি বছর ধরে হিসাব করা হলে দেখা যাবে, প্রকৃত মজুরি কমেছে। মূল্যস্ফীতি ও মজুরির ভিত্তি বছর একই হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার (আইএলও) ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বৈশি^ক মজুরির প্রতিবেদন: ২০২০-২১ প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দেশভেদে নিম্নতম মজুরি ছিল ৪৮ ডলার (পিপিপি) থেকে ২হাজার ১৬৬ ডলার। এর মধ্য সর্বনিম্ন ছিল বাংলাদেশ (৪৮ ডলার)। এ প্রতিবেদন থেকে বলা যায়, বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে নিম্নতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্রসীমার নিচে।

আমাদের দেশে জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে ঠিক, তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দারিদ্রসীমার নিচে থাকা ও নিম্ন আয়ের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও কষ্টে রয়েছে। বিশেষ করে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জাম একটি প্রত্রিকায় বলেছেন, তিন শ্রেণির মানুষ এখন টিসিবির ট্রাকের পিছনে লাইন দিচ্ছেন। এক. দরিদ্র মানুষ, যাদের সামান্য মূল্যবৃদ্ধিতেই সংকটে পড়তে হয়। দুই. নিম্ন আয়ের মানুষ, যাঁরা বাজার থেকে পণ্য সামগ্রী কেনেন। তবে দীর্ঘ মেয়াদি মূল্যস্ফীতিতে তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে খেতে হচ্ছে। তিন. এই শ্রেণি এখনও সঞ্চয় ভাঙ্গেনি, তবে পরিবারের ব্যয় ঠিক রাখতে তারা খরচ কমানোর চেষ্টায় রয়েছে। গতবছরের (২০২১) শেষের দিকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। এর আগে কোভিডের কারণে বিশ^ব্যাপী পণ্য উৎপাদন গুরতরভাবে কমে গিয়েছিল। চাহিদাও ছিল না। পরে চাহিদা বাড়ায় পণ্যের উৎপাদন বেড়ে যায়। বাড়ে পরিবহন ব্যয়ও। আবার ওমিক্রনের কারণে বন্দরে পণ্যের খালাসও ব্যাহত হয়। এসব কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, গ্যাস, সার ইত্যাদির দাম বেড়ে যায়। এসব ইউক্রেন সংকটের আগের ঘটনা। করোনাকালে যারা কাজ হারিয়েছিলো তখন তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, কাজের জন্য দেয়া সরকারের নানা প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা প্রকৃত অভাবীরা ঠিকভাবে পায়নি নানা স্বজনপ্রীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে।

দেশ যখন করোনার প্রকোপ থেকে অনেকটা মুক্ত তখন বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি সীমিত আয়ের মানুষকে মহা দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। কৃষিপণ্যের উৎপাদনকারী কৃষকেরা প্রকৃত মূল্য পায় না, অন্যদিকে বাজার কারসাজির জন্য ভোক্তাদের অনেক দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হয়। এজন্য বাজার তদারকির কাজটি জোরদার করতে হবে, অসাধু ব্যবসায়ীদের কৃত্রিম সংকট তৈরি রোধ করতে হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয় বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু উন্নয়ন বৈষম্যের কারণে সাধারণ মানুষের উন্নয়ন তেমন হয়নি। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই হবে, যখন সব মানুষের মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া নিশ্চিত হবে। যখন প্রতিটি সামর্থ্যবান নাগরিক যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাবে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির তুলনায় তাদের মজুরিও বৃদ্ধি পাবে। ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে সহায়তা দিতে এককোটি বিশেষ কার্ড দেয়ার কথা বলেছেন। এ কার্ডের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল ও চিনি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা টার্গেট করেছি এক কোটি মানুষকে স্পেশাল কার্ড দেব, যেটা দিয়ে তারা ন্যায্যমূল্যে জিনিস কিনতে পারবে। যে ৩৮ লাখকে আমার টাকা দিচ্ছি, তার তো থাকবে, তার বাইরে আরও এক কোটি লোককে দেব। এছাড়া পঞ্চাশ লাখ লোককে একটা কার্ড দেওয়া আছে, সেটা থেকে তারা ১০ টাকায় চাল কিনতে পারবে। সেই ব্যবস্থাও করা আছে।’

প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। এর মাধ্যমে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারণ কিছুটা হলেও সহনীয় হতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো, কোটি মানুষের তালিকা কারা করবে, কীভাবে করবে? অতীতের মতো তালিকা নিয়ে যেন নয় ছয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। প্রকৃত অভাবী ও নিম্ন আয়ের জনগণ যেন তালিকাভুক্ত হয় ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। এ দিকে পৌনে দুই কোটি কৃষকের আয় বাড়াতে বিশ^ব্যাংক বাংলাদেশকে বারো কোটি ডলার দেবে, যা বর্তমান বাজারদরে টাকার অংকে এক হাজার বত্রিশ কোটি টাকা। এ অর্থ দিয়ে হিমাগার স্থাপনের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারের উন্নতি নিশ্চিত করা এবং ধান, মাছ ও চিংড়ি চাষের সহায়তা করা যাবে। এতে মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৩৭ শতাংশে, সবজি উৎপাদন ১০ শতাংশে ও চাল উৎপাদন সাড়ে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করে অপচয় রোধ করে স্বচ্ছতা ও জাবাদিহির সাথে সঠিক সময়ে সম্পন্নের দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের সাথে সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ ২৮টি এসডিজি সূচকের দিকে নজর দিতে হবে। সূচকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত জনগোষ্ঠি, কৃষিবর্হিভূত অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান, কাজ বা পড়াশুনা নেই এমন তরুণ গোষ্ঠি, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু, নারীর উপর গৃহনির্যাতন, স্যানিটেশন সুবিধা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি সুবিধা এবং জিডিপি রাজস্ব অনুপাত ইত্যাদি। এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য পিছিয়ে পড়া মানুষের ক্রয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হবে। বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এত বেশি যে, তাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে। এজন্য গরিব ও নিম্ন মধ্যবৃত্ত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি আয়ও বাড়াতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রান্তিক মানুষে
আরও পড়ুন