Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

সর্বজনীন পেনশন, আশা করা যায় জনকল্যাণে যথাযথ ভূমিকা রাখবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০২২, ১২:০৭ এএম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ষাটোর্ধ নাগরিকদের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। সাবেক অর্থমন্ত্রীও এ বিষয়ে বলেছিলেন। ২০১৬ সাল থেকে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও সর্বজনীন পেনশন চালু করার কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি বিষয়টি সংবিধানভুক্তও (সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাঁদের পেনশন সুবিধা দেওয়া হবে)। কিন্তু এত কিছুর পরও সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, আগামী ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এটা কার্যকর হওয়া এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মীরা এই কর্মসূচির বাইরে থাকবেন। কারণ, তাঁরা এরই মধ্যে পেনশন সুবিধা পাচ্ছে। এর পর থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সব মহলেই। তবে এ ব্যাপারে কেউই সঠিকভাবে কিছু বলতে পারছে না। কারণ, বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি সরকারিভাবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথম দিকে এটি ঐচ্ছিক হবে। পরবর্তীতে সবার জন্য বাধ্যতামূলক হবে। অর্থ বিভাগ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট থাকবে। মাসিক সর্বনিম্ন জমার অর্থ নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা দিতে পারবে। অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হলে হিসাব সাময়িক বন্ধ থাকবে। পরে জরিমানাসহ বকেয়া দেওয়া যাবে। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবে। ৬০ বছর পূর্তিতে নির্ধারিত হারে পেনশন পাবে আমৃত্যু পর্যন্ত। ৭৫ বছর বয়সের আগে কেউ মারা গেলে তার নমিনি পেনশন পাবে ৭৫ বছর পর্যন্ত। তবে জমাকারীর অবর্তমানে এককালীন টাকা তোলার সুযোগ থাকবে না। আবেদনের প্রেক্ষিতে পেনশনের ৫০% পর্যন্ত ঋণ পাওয়া যাবে। এ জন্য সুদ দিতে হবে। কেউ ১০ বছর অর্থ জমা দেওয়ার পর মারা গেলে টাকা পাবে তাঁর নমিনি। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য একটি আলাদা পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। প্রণয়ন করা হবে পৃথক আইন। পেনশনের জন্য নির্ধারিত জমা দেওয়া অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। কেউ স্থান পরিবর্তন করলেও তাঁর অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে। দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের জমা দেওয়া অর্থ নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে।

এছাড়া, অর্থ বিভাগ থেকে অনুমানভিত্তিক একটি হিসাবে বলা হয়েছে, কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা জমা দিলে ১০ শতাংশ মুনাফা এবং আনুতোষিক ৮ শতাংশ হিসাব ধরে ৬০ বছর বয়সের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪,৭৭৬ টাকা পেনশন পাবে। কেউ ৩০ বছর বয়সে অর্থ জমা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১৮,৯০৮ টাকা পেনশন পাবে। চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও বেশি হবে।

স্মরণীয় যে, সর্বজনীন পেনশন প্রথা বিশ্বে নতুন নয়। অনেক পুরানা। বহু দেশে এটা চালু রয়েছে অনেক দিন থেকেই। তন্মধ্যে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ সব দেশে সর্বজনীন পেনশনের সুবিধাদির মধ্যে কিছু তারতম্য রয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে সঠিকভাবেই। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের বয়স্ক মানুষ খুবই উপকৃত হচ্ছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কয়েকটি রাজ্যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে এবং খুব ভালভাবে চলছে। বাংলাদেশে এর ভবিষ্যৎ কী হবে তা বলা কঠিন। কারণ, আমরা সব কিছুই শুরু করি ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। কিন্তু কিছুদিন পর সেটা লাপাত্তা হয়ে যায়। সে জন্য কারও জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয় না। দ্বিতীয়ত: দেশে অনেক প্রকারের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান আছে। তাদের উপকারভোগীর অর্ধেকের বেশি ভুয়া। অর্থাৎ, যারা প্রাপ্য নয়, তারা পাচ্ছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের কারণেই এই মহৎ উদ্যোগগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে আশানুরূপ কল্যাণ হচ্ছে না।

দেশের সর্বজনীন পেনশন স্কিম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানারূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করছেন। যার অন্যতম হচ্ছে: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০। সর্বজনীন পেনশনের জন্য সরকারি এমপ্লয়ী ১৪-১৫ লাখ বাদ দিলেও প্রায় ৮.৩০ কোটি মানুষকে এখন সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আনতে হবে। এই সংখ্যা প্রতি বছর বাড়বে। এই ব্যাপক লোকের কতজন মাসিক এক হাজার টাকা করে পেনশন স্কিমে জমা দিতে পারবে? বর্ণিত লোকের অর্ধেক মানুষ সক্ষম হবে বলে মনে হয় না। কারণ, প্রতিটি পরিবারে ১৮ বছর বয়স অতিক্রম করা মানুষের সংখ্যা গড়ে কমপক্ষে ৩-৪ জন করে আছে। সে মতে, পরিবার প্রতি মাসে ৩-৪ হাজার টাকা করে জমা দিতে হবে পেনশন স্কিমে। করোনা মহামারিসৃষ্ট মন্দা, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বেকারত্বের সর্বাধিক হারের সময়ে বর্ণিত মানুষের অর্ধেকেরও বেশির পক্ষে তা করা সম্ভব হবে না। বাকী মানুষের অনেক অংশ অসচেতনতার কারণে এ পথে সহসাই যাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া চালু করার পর তা আবার বন্ধ করে দিতে পারে অনেকেই। এভাবে বর্ণিত ৮.৩০ কোটি মানুষের প্রায় তিন চতুর্থাংশ বা ৭৫% মানুষ সর্বজনীন পেনশনের আওতার বাইরে থাকতে পারে। এ অনুমান সঠিক হলে মাত্র এক চতুর্থাংশ তথা ২৫% মানুষ সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আসতে পারে। যারা মূলত সচ্ছল বা ধনী। আর সেটা হলে ‘সর্বজনীন পেনশনে’র স্থলে এটা ‘সচ্ছল তথা ধনীদের পেনশন’-এ পরিণত হবে। তাতে করে এই কর্মসূচীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হবে। অবশ্য, অর্থ মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় বলা হয়েছে, দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। এটা হলে গরিব মানুষের অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়বে। অবশ্য, এই গরিব নির্ধারণ করা নিয়ে মহাকেলেংকারী সৃষ্টি হতে পারে। এই পেনশন স্কিমের প্রদেয় ঋণ এবং বিনিয়োগ সরকারি ব্যাংকগুলোর মতো খেলাপি হয়ে মরণদশায় পতিত হবে না তারও নিশ্চয়তা কম। এই কর্মসূচির সদস্যদের মাসিক চাঁদা আদায়, বকেয়া চাঁদা সুদসহ আদায়, ঋণ প্রদান, ঋণের সুদসহ কিস্তি আদায়, মাসিক পেনশন প্রদান, নতুন সদস্য যুক্ত করা, মৃত্যু ব্যক্তির নমিনিকে পেনশন প্রদান করা, সদস্য পদ প্রত্যাহার, স্টেটমেন্ট সার্বক্ষণিক হালনাগাদ রাখা, সদস্যদের বার্ষিক স্টেটমেন্ট প্রদান, পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ এবং তা আদায় ইত্যাদি এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, যা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সহজসাধ্য বিষয় নয়। খসড়ায় বলা হয়েছে, পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। কিন্তু সেটা খাজনার চেয়ে বাজনা যেন বেশি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, সেটা হলে একদিকে কল্যাণ হবে অন্যদিকে অকল্যাণ হবে।

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি খুবই কল্যাণকর। দেশে এটা চালু করতে হবে যথা শিগগির। তাতে কতজন এলো সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে, যা আসে তা নিয়েই শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়ত এর নীতিসমূহ সময়োপযোগী করতে হবে এবং কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতে হবে অত্যন্ত সৎ, দক্ষ ও মানবিক ব্যক্তিদের। প্রতিষ্ঠানের জনবলের সকলকেই হতে হবে সৎ, কর্মঠ ও প্রযুক্তিতে দক্ষ। প্রতিষ্ঠানকে করতে হবে শতভাগ প্রযুক্তি ভিত্তিক। এই কর্মসূচির সুফল নিয়ে সার্বক্ষণিক ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা খাতের মতো দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ কিংবা নানা হয়রানির শিকার যেন না হয় সেদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। এসব হলেই এই কর্মসূচির কল্যাণ মানুষের ভাগ্যে জুটবে। ফলে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। তখন মানুষ ধীরে ধীরে এই কর্মসূচির দিকে ঝুঁকে পড়বে। তখন এটি সচ্ছল বা ধনীদের পেনশনের স্থলে সর্বজনীন পেনশন-এ পরিণত হবে। কোটি কোটি মানুষের ব্যাপক কল্যাণ হবে।বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবে না। কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়ে জীবনের শেষ সময়টুকু নিঃসঙ্গভাবে থাকতে হবে না। পেনশনের টাকা দিয়ে স্বগৃহেই জীবন সায়াহ্নে সুখে-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, যেসব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শতভাগ পেনশন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির সুবিধা রয়েছে; তাদের আপাতত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত না করাই শ্রেয়। নতুবা তারা ডাবল বেনিফিটেড হবে। কিন্তু যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শতভাগ পেনশন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির সুবিধা নেই, তাদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার সূচনা লগ্নেই। নতুবা তারা দ্বিমুখী ক্ষতির শিকার হবে, যা কাম্য নয়।দ্বিতীয়ত বিষয়টি সর্বজনীন পেনশন স্কিমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। অবশ্য, দেশের বেসরকারি খাতের কোন প্রতিষ্ঠানেই পেনশন সিস্টেম নেই তা নিশ্চিত। প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির সুবিধা কোনটিতে আছে আর কোনটিতে নেই তা চিহ্নিত করা কঠিন। তবে, এটা নিশ্চিত যে, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই চাকরির নিয়োগ পত্র দেওয়া হয় না। তাই সেখানে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। সে অবস্থায় অবসরোত্তর কিংবা অবসানোত্তর চাকরির সুবিধাদি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবুও বেসরকারি চাকরিজীবীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করার আগে বিষয়টি যাচাই করে দেখা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • Dijen sarker ৪ আগস্ট, ২০২২, ৩:৫৯ পিএম says : 0
    Govt. is Very good idea
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সর্বজনীন পেনশন
আরও পড়ুন