পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতিতে নিম্নবিত্তের মানুষের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মধ্যবিত্তের মানুষও দিশাহারা অবস্থায় পতিত হয়েছে। করোনাকারণে আগে থেকেই দ্রব্যমূল্য অধিকাংশ মানুষের ক্রয়সামর্থের বাইরে চলে গিয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুুদ্ধ মূল্যপরিস্থিতিকে রীতিমত ভয়াবহ করে তুলেছে। উচ্চবিত্তের কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া তাবৎ মানুষ নিত্যপণ্যের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধিতে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছে। যাদের মাসিক আয় ৫৫০০ হাজার থেকে ১৬০০০ টাকার মধ্যে, তাদের পক্ষে পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কেনাও অসম্ভবপর হয়ে উঠেছে। এর ওপর আছে সংসারের অন্যান্য খরচ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, স্বল্প ও নিম্নআয়ের মানুষের অনেকেই খাদ্যপণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। খাওয়াও কমিয়েছে একবেলা। অনেকে আয়-রোজগার বাড়ানোর পন্থা হিসেবে ছেলেমেয়েদের স্কুল ছাড়িয়ে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। করোনা ও অন্যান্য কারণে অনেকের চাকরি গেছে, অনেকের আয় আগের চেয়ে কমেছে। তাদের কীভাবে দিন কাটছে, কল্পনাও করা যায় না। কোনোভাবে একবেলা খাবার জোটানোও তাদের পক্ষে কঠিন। কেমন আছে মধ্যবিত্ত? মোটেই ভালো নেই। তাদের এখন আর মধ্যবিত্ত বলে চেনার উপায় নেই। অনেকে নিম্নবিত্ত, অনেকে তারও অধম হয়ে পড়েছে। ফুটপাতের দোকানে কম দামের পণ্য কিনতে তাদের দেখা যায়। টিসিবি’র ট্রাকের লাইনেও তার ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। পুরুষের মুখে মাস্ক এবং মহিলার মুখে মাস্কসহ বোরকা পরা থাকলেও তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ থেকে বুঝা যায়, তারা ট্রাকের পেছনে লাইনধরার মানুষ নয়। অবস্থার ফেরে পড়ে তাদের এই হাল। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জনৈক মফিজুর রহমানের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি এই চাকরিজীবীর মাসিক আয় ৫০০০০ টাকা। তাতে তার সংসার চলে না। ৩০০০০ হাজার টাকা বেরিয়ে যায় বাসাভাড়া এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-মোবাইল-ইন্টারনেটের বিল দিতে। বাকী টাকা দিয়ে ৫ জনের একটি পরিবারের ৩০ দিনের খানা, দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসা খরচ, সাংসারিক অন্যান্য খরচ, নিয়মিত হাতখরচ, যাতায়াত ভাড়া মেটাতে মাস শেষে ধার-দেনা করতে হয়।
মফিজুর রহমানের সংখ্যা এখন কত, তার কোনো হিসাব বা পরিসংখ্যান না থাকলেও বলা যায়, তাদের সংখ্যা অনেক এবং এ সংখ্যা বাড়ছে। ক’দিন আগে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, সঞ্চয়পত্র কেনা কমেছে। অন্য এক খবরে বলা হয়েছিল, ব্যাংকের আমানত কমেছে। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, যারা সঞ্চয়পত্র কিংবা ব্যাংক আমানতের লাভ দিয়ে সংসার চালাতো, তারা আর কুলাতে না পেরে সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। মানুষ যখন সঞ্চয় ভেঙে খায়, যখন সংসারে আয় বাড়াতে ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ করে দেয়, যখন কারো ৫০০০০০ টাকা বেতনও সংসার চলে না, মাস শেষে ধারকর্জ করতে হয়, যখন মধ্যবিত্ত তার অবস্থান নিয়ে কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারে না, তখন বুঝা যায়, কী কঠিন অবস্থার মধ্যে দেশের মানুষ দিনাতিপাত করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগামিতা বুঝাতে আমরা সাধারণত আকাশচুম্বী কথাটি ব্যবহার করি। কিন্তু এখন এই কথাটি যথেষ্ট নয়। বাস্তবতা তো এই যে দ্রব্যমূল্যর ক্রমাগত লাফিয়ে লাফিয়ে চলার প্রতিক্রিয়া সর্বব্যাপী এবং মারাত্মক। এর শিকার তারা যাদের আয় বা ক্রয় সামর্থের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য সংগতিশীল নয়। সরকারের তরফে অনেকেই বলে থাকেন, দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তাদের যুক্তি, কোনো দ্রব্যসামগ্রী তো অবিক্রীত থাকছে না। কোনো মানুষ তো খাদ্য কিনতে না পেয়ে কিংবা না খেয়ে মারা যাচ্ছে না। যারা এই যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, তারাও জানেন, এর চেয়ে খোড়া বা দুর্বল যুক্তি আর কিছু হতে পারে না। মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়ছিল, এটা অস্বীকার করা যায় না। তবে গত দু-আড়াই বছরে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার ব্যয়ের মধ্যে একটা বড় ব্যবধান রচিত হয়েছে। একারণে দৃশ্যত বাজারে কোনো পণ্যের অভাব না থাকলেও মানুষ তা কিনতে পারছে না। সামর্থের অভাবই এখানে প্রধান। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দৈশিক ও বৈশ্বিক কারণ যাই হোক, তা এতটা বাড়ার কথা নয়। বেড়েছে ও বাড়ছে এক শ্রেণীর অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীর কারণে। তাদের কারসাজি ব্যর্থ করা এবং লোভের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।
কোনো পণ্যবাজারের ওপরই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ বরাবরই বলবৎ আছে ব্যবসায়ীদের। চাল, ডাল, চিনি, তেল, পিঁয়াজ থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপণ্য নেই, যার দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পণ্যের দামের ঊর্ধ্বমুখী রশি টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। সয়াবিন তেলের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। সয়াবিনের দাম ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামত দফায় দফায় বাড়িয়েছে। সরকারের কথা, হুমকি-ধমকি তারা কেয়ার করেনি। শেষ পর্যন্ত সরকারই সয়াবিন তেলের আমদানি ভ্যাটমুক্ত করে দিয়েছে। বাজারে এরও প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। অনেক সময় বলা হয়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সরকার। এটাও যে, একটা অজুহাত ও ব্যর্থতা ঢাকা দেয়ার অসিলা, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। যারা যথেষ্ট মুনাফা লাভের লক্ষ্যে পণ্যাদির মূল্য বাড়িয়ে যাচ্ছে, মানুষের কষ্ট, দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা বাড়াচ্ছে তারা রেহাই পেতে পারে না। সরকারকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক করার জন্য টিসিবি ও ওএমএস’র মাধ্যমে জরুরি পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিক্রীর ব্যবস্থার করতে হবে। বিশ্ববাজারে কিছু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেশের বাজারে পড়ার কথা। বলা হচ্ছে, আগামীতে এসব পণ্যের দাম আরো বাড়তে পারে। আশংকার এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমানোর বিকল্প নেই। আমদানি-নির্ভরতা কমানোর বিকল্প নেই। আমদানিনির্ভরতা কমানোর একটাই পন্থা, উৎপাদন বাড়াতে হবে। খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন দেশের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে করা হলে পণ্যের সংকট মোচন ও বাজার ম্যানিপুলেট করার চক্রান্ত থামানো সম্ভব হবে। সরকার এদিকে বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে বলে আমরা আশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।