Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২২, ১২:০৬ এএম

সামনে রোজা। স্বস্তির খবর নেই। চাল-তেল থেকে মাছ-সবজি সব বাজারেই কারসাজি। চাতুরি। রমজানে ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনি, মসলাসহ অনেক পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে, একদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির তকমা আরেকদিকে, সরকার মাঝেমধ্যে চাল-তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ঠিক করে দেয়। এতে বাজারে উল্টো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। দাম আরো বাড়ে। বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে তা আর কমে না। কমতে চায় না। সোজা করে বললে কমতে দেয়া হয় না। উপরন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে উল্লেখ করে কারসাজিকে ন্যায্যতা দিয়ে দেয়া হয়। একদিকে সরকার, বাজার অর্থনীতির কথা বলে আবার অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দামে কারসাজি বা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেয়, যা জাতির সাথে রীতিমত মশকরা।


ন্যায্যমূল্যের দ্রব্য বিক্রির গাড়ির পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন কিংবা তা ধরার জন্য প্রাণপণ দৌড় দেখে কে বলবে, এ দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধকলেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে মানুষের আয়ের আসল চিত্র। যদি সত্যিই আয় বেড়ে থাকে তাহলে মানুষ কেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ নিতে পারছে না?

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় ওঠে এসেছে, কোভিড-১৯ কারণে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত বেকার হয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষ। কর্মজীবীদেরও আয় কমেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে।

সমস্যা হলো আমরা সবসময় প্রচারমুখী ও গড়ভিত্তিক সংখ্যাতত্ত্ব দিয়েই অর্থনীতিকে বিচার করি। মানুষের আয় ব্যতিরেকে বৈষম্য, ভঙ্গুরতা কিংবা সম্মানবোধকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। একসময় অর্থনীতিতে শুধু সংখ্যার বিচারেই দারিদ্র্য মাপা হতো। নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে আয় করতে পারলে ধরা হতো তিনি দরিদ্র নন, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন বিশ্বব্যাপী মানুষের আয়ের পাশাপাশি এ বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়। বাস্তবতা হলো, বর্তমানে দেশে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা মানুষ। দিনকে দিন বেড়েই চলেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়ছে না মানুষের আয়। এ অবস্থায় বিশেষ করে শহরের স্বল্প আয়ের মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে গেছে। ভালো নেই মধ্য আয়ের কর্মজীবী মানুষেরাও। শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় সবকিছুর দামই হু হু করে বাড়ছে। এতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্য আয়ের মানুষদেরও। মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করা ব্যক্তিরাও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, অফিসে যাতায়াতসহ সংসারের যাবতীয় খরচের সঙ্গে যোগ হয়েছে নিত্যপণ্যের লাগামহীন বাড়তি মূল্য।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, সরবারহ সংকট, উৎপাদন কম হওয়া এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধি দেশের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ। ফলে এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র টিসিবি’র মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি ছাড়া দ্রব্যমূল্য কমানোর কোনো বিকল্প রাস্তা দেখছে না সরকার। কিছুই করার নেই বলে সম্প্রতি এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, তেল, চিনি ও ডাল এই তিনটি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে বলেই দেশেও এর চাপ পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যেটার দাম বেড়ে গেছে, সেটা যারা কিনবে তারা তো আর লোকসানে বিক্রি করবে না। এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছে, সরকার সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে আদমানি শুল্ক কমিয়ে দিলে দাম কিছুটা হলেও কমে যাবে।

কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) সভাপতি মনে করেন, সব মিলিয়ে দেশে একটি নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে টিসিবি’র কার্যক্রম বাড়ালে সার্বিক বাজার পরিস্থিতিতে তেমন কোনো ফল না হলেও অন্তত কিছু মানুষ এতে উপকৃত হবে। এছাড়া পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, সরবারহ সংকট, উৎপাদন কম হওয়া, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে। তাছাড়া আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়লে ট্যাক্সের পরিমাণও বেড়ে যায়। এতে বাজারের অন্যান্য পণ্যের দামেও প্রভাব ফেলে। এখানে করোনা সংকটও এর জন্য দায়ী। এ অবস্থায় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকে। বেশি জোর দিতে হবে মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে, যাতে মানুষের আয়-রোজগার বাড়ে।

গত মাস কয়েক ধরে চাল, ডাল, তেল, পানি থেকে পান-সুপারি পর্যন্ত বেশিরভাগ পণ্যের দামের উল্লম্ফনে কাহিল তারা। মাথার পেছনের আয়ের গড়ের অংকে তারা সামর্থ্যবান। আয়ের অংকটা মাথার পেছনে বলে তারা তা চোখে দেখে না, মাথার সামনে থাকলে দেখত বিষয়টা এমন? আবার নিত্যপণ্যের এমন দামের প্রতিবাদে রাস্তায় তেমন কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভও নেই। তার মানে তারা সব মেনে নিয়েছে? সামর্থ্য আছে বলেইতো কেনাকাটা করছে। বাজারে কি অবিক্রীত কিছু থাকছে? দেশে বিভিন্ন সময় মন্ত্রিবচনে ঢাকা শহরের বাথরুমে গিয়ে সিঙ্গাপুর দেখা বা বাংলাদেশের মানুষ বেশি ভাত খায় বলে চালের দাম বেড়ে গেছে, এমন যুক্তিও আছে। সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, সারের মূল্যে ভর্তুকি টানতে গিয়ে সরকারের খুব দুর্গতি হচ্ছে। ইশারা বা ইঙ্গিত নয়, সামনে সার-বীজসহ কৃষিখাতে কী খড়গ আসতে পারে সেই বার্তা স্পষ্ট তার বক্তব্যে। এর আগে বলেছেন, চালের এত দাম বৃদ্ধির পরও দেশে কোনো হাহাকার নেই, আয় বেড়েছে বলে মানুষের কষ্ট হচ্ছে না। মানুষ এখন গরু-ছাগলকেও চাল খাওয়াচ্ছে। এরও আগে, মানুষ ভাত বেশি খায় তাই চালের দাম বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। আবার বাণিজ্যমন্ত্রীসহ তার সহকর্মীরা যেমন মাঝেমধ্যে বলছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছু করার নেই। অবশ্য করণীয় কিছু না থাকলেও তারা জাতিকে বাজার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস দেন। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি-ধমকি দিয়ে সংবাদ শিরোনামে আসেন। আগামী রমজানে স্থিতিশীল বাজারের আশাও দেখান। কিন্তু মানুষের অসহায়ত্বের সঙ্গে এমন মশকরা না করলেই নয়?

ক’দিন পরপর বাণিজ্যমন্ত্রীর বিশেষ কাজই যেন কোনটার দাম কেন বেড়েছে এবং ২ দিন পর কেন আরও বাড়বে, সেই যুক্তি দেওয়া। এরপর আবার দেখা যায় তিনি কোনো পণ্যের নাম মুখে নিলেই সেটার দাম বেড়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে। বলেছেন, চাল নিয়ে টেনশন না করতে। এর দুদিন পরই চালের দাম বেড়ে গেছে। তেল-পেঁয়াজ নিয়েও একই ঘটনা। মুখের এ ফুল চন্দনের মধ্যে তিনি এখন বলছেন, রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার সহনীয় থাকবে। এতে রমজানে নিত্যপণ্যের কী দশা হতে পারে, এ নিয়ে আগাম টেনশন ভর করেছে জনমনে অনেকের মধ্যেই। নিদারুণ এই দশার শিকাররা মোটেই এমন বর্তমানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ভাবেনওনি কোনোদিন। এক সময় তুলনামূলক কম দামে পণ্য কিনতে এক শ্রেণির নগরবাসীর কেউ কেউ বিভিন্ন বৌ বাজারে ঢু মারতেন। সতর্ক থাকতেন যেন চেনাজানা কেউ না দেখে। অবশ্য বর্তমানে করোনার কারণে মাস্ক তাদের জন্য টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধরতে বা বৌবাজারে ঢুকতে বেশ লাগসই হয়েছে।

এরইমাঝে বৌবাজারের নামের সংস্করণ হয়েছে ফকিন্নি বাজার নামে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৌবাজার, গরীবের বাজার নামে খ্যাত এ ধরনের বাজারে কম দামে নিম্নমানের ডাল, আটা, মসলা, সবজি মেলে। এগুলোর বেশিরভাগ দোকানি নারী হলেও সবাই বৌ বা ফকিন্নি নয়। ক্রেতারাও তা নয়। তুলনামূলক কম দামে সদাই কেনার বাজারের রূপক অর্থে নামকরণ হয়ে গেছে বৌবাজার, হাল সংস্করণ ফকিন্নি বাজার। এসব বাজারের বিক্রেতারা কারওয়ানবাজার- শ্যামবাজারসহ বিভিন্ন আড়ত বা পাইকারি মোকাম থেকে ঠিকা দরে কিনে আনে টুটা-ফাটা, উচ্ছিষ্ট বা ফেলে দেওয়ার মতো মালামাল। সেগুলোকে বাঁচাই করে অন্যান্য পণ্যের সাথে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিভিন্ন স্থানে পসরা বিছিয়ে বসে। এক সময় এগুলোর কাস্টমারও ছিল নির্দিষ্ট, সীমিত। এখন তা অবারিত। ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম বা আরও কম পরিমাণের পণ্যের ভাগাও এখান থেকে কেনা যায়। রয়েছে পলিথিনের প্যাকেটে ১০ টাকার তেল কেনার ব্যবস্থাও। আর তাই মাস্কে পোক্ত করে মুখ ঢেকে ঝটপট একটু-আধটু সদাই সেরে শর্টকাটে কেটে পড়া যাচ্ছে এসব কথিত বৌ বা ফকিন্নি বাজার থেকে।

এসব বাজারের অংশীজনরা সবাই নিম্ন বা মধ্যম আয়ের মানুষ নয়। উচ্চমানেরও আছে। করোনার কারণে চাকরিচ্যুত, বেতন অনিয়মিত বা পথে বসা ব্যবসায়ীও আছে। পরিস্থিতিটা এই শ্রেণির জীবনকে কোন দশায় নামিয়েছে তার কিছুটা উপলব্ধি করা যায় বৌ বা ফকিন্নি বাজারমুখীদের ভিড় দেখলে।

পরিশেষে বলতে চাই, কোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। তাই ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণসহ সকল ক্ষেত্রে সরকারের দরকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। অসাধু ব্যবসায়ী বা কোনো মহল যেন বিশেষ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের কারসাজি করতে না পারে-টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। কারণ চাল-তেল থেকে শুরু করে সুঁই-সুতা পর্যন্ত পণ্যের দর মানুষকে এখন ঘুমে নয়, সজাগেও আঁতকে তুলছে। সকলের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে রীতিমতো ‘নাভিশ্বাস’ উঠেছে। বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।ঘরে বা চার দেয়ালের মাঝে হা-পিত্যেস করা ছাড়া কিছুই যেন করার নেই, প্রকাশ্য নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। নেই প্রতিবাদ। তার মানে কি মানুষ সব মেনে নিচ্ছে? নাকি তারা অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ
আরও পড়ুন