Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিলম্বিত বার্ধক্যের সন্ধানে

প্রকাশের সময় : ৯ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

কোনো মানুষ বুড়ো হতে চায় না। বার্ধক্য, শারীরিক, মানসিক এবং অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক কারণেও যন্ত্রণাক্লিষ্ট হয়। অনেক বৃদ্ধ অবক্ষয়জনিত দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে বাকি জীবন কষ্ট পেয়েই মারা যান। বৃদ্ধজীবন উপভোগ করা যায় না। জীবনকে কাজেও লাগানো যায় না। নিঃসঙ্গতার সমস্যাও ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়।
সঙ্গত কারণেই মানুষ তারুণ্যকে ধরে রাখতে চায়। বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা দিলে তা থেকে উত্তরণের পথ খোঁজে। ডাক্তার-কবিরাজের শরণাপন্ন হয় যদি জীবনটাকে আরো কিছুদিন বার্ধক্যের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়। বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপিত প্রসাধনীও অনেকে ব্যবহার করেন। অনেকে কসমেটিক শল্য চিকিৎসা করেও দেহের কোনো কোনো সম্ভাব্য অংশের বার্ধক্যের চিহ্ন অপসারণের প্রয়াসী হন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাময়িক উন্নতি হলেও তা অল্প সময়ের জন্যই হয়। শেষপর্যন্ত বার্ধক্য এসেই যায়।
যৌবন ধরে রাখতে এবং বাড়াতে ভেষজ জিনসের মূলজাত ওষুধ সারাবিশ্বে জনপ্রিয়। তবে জিনসের গুণাবলীর ধারণা বৈজ্ঞানিক মহলে বিতর্কিত। কোনো কোনো মহাপরুষ দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। দীর্ঘজীবী মানুষের বার্ধক্যও নিশ্চয় দেরিতে এসেছিল। পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘজীবী হয়। দীর্ঘজীবী মানুষের বার্ধক্যের আগমনের বিলম্বিত হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে হবে। বার্ধক্যবিরোধী সংগ্রামে এ অঞ্চলের চিকিৎসাবিদ্যা আয়ুর্বেদ যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। আয়ুর্বেদ ‘রসায়ন’ বিভাগ নামে একটি বিশেষ বিভাগ বার্ধক্য চিকিৎসায় নিবেদিত আছে। জীবনকে দীর্ঘ করা, এই ‘রসায়ন’ বিভাগ সক্রিয়। ‘রসায়ন’ কতগুলো ভেষজদ্রব্য যেমন আশ্বগন্ধা, আমলকি, মঞ্জিস্টা, হরিতকি, পুনর্নবা এবং অন্যান্য আরো অনেক ভেষজদ্রব্য বার্ধক্যবিরোধী চিকিৎসায় ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়। কতগুলো ধাতু যেমন স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ এবং খনিজদ্রব্য শিলাজিৎও বার্ধক্যবিরোধী চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক বিজ্ঞানও বার্ধক্যবিরোধী গবেষণায় চলেছে। বিজ্ঞানীরা বার্ধক্যের আগমনকে বিলম্বিত করার কিছু উপায়ও বলেছেন। বর্তমান বিজ্ঞান বার্ধক্যের আগমন বিলম্বিত করা, বার্ধক্যে স্বাস্থ্যের অবনতির হার কমানো এবং বেশি বার্ধক্যকালীন জরাগ্রস্ত হওয়ার সময় কমানোর দিকেই বেশি নজর দিয়েছে।
বার্ধক্যকালীন দেহের দীর্ঘজীবী কোষে (নিউরিন) কালছে হলদে রঙের দাগ দেখা যায়। লিপোফুচিন যৌন জমা হওয়ার জন্যই এই দাগ। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, ভিটামিন ‘ই’ এবং ভিটামিন ‘সি’-এর বার্ধক্যবিরোধী ধর্ম আছে। এই পরিস্থিতিতেই বার্ধক্যে এবং বার্ধক্যে পৌঁছানোর আগে থেকেই এই দুটি ভিটামিন ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়। বার্ধক্যবিরোধী সংগ্রামে সকল দিকেই নজর দিতে হয়। অসুখ-বিসুখ যাতে না হয় বা কম হয়। শরীরের প্রয়োজনীয় যাবতীয় ভিটামিনের কোনোটারই যাতে ঘাটতি না হয়। শরীরের প্রয়োজনীয় অজৈব মৌলের বিশেষত সেলেনিয়ামের যেন ঘাটতি না হয়। ভিটামিন ‘ই’ এবং ভিটামিন ‘সি’-এর বার্ধক্যবিরোধী ভূমিকা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে।
বৃদ্ধের স্বাস্থ্য অবশ্যই ভালো রাখতে হবে। পথ্য বিজ্ঞানীর পরামর্শ নিয়ে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। বৃদ্ধকে প্রচুর পানীয়জল খেতে হয়। ধূমপানসহ যাবতীয় নেশাজাতীয় দ্রব্য অবশ্যই বর্জন করতে হবে। বৃদ্ধের মনের অবস্থাও ভালো থাকতে হবে। কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগ ভোগের কারণ যেন না ঘটে। জীবনযাপন প্রণালী সঠিক হলে, বার্ধক্যে স্বাস্থ্যের অবনতির হার কম হবে। বার্ধক্যের শুরু দেরিতে হবে।
বার্ধক্যকালীন অসুখ-বিসুখের চিকিৎসার ব্যাপারেও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যে সকল ওষুধের বেশি প্রতিক্রিয়া অথবা বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, সেই সকল ওষুধ সাধ্যমত পরিহার করে চলতে হয়। বৃদ্ধের চিকিৎসানীতি হবে, স্বাস্থ্যের যেন আর অবনতি না হয়। অসুখ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তির প্রচেষ্টায় আয়ুর উপর যেন আঘাত না হয়। বয়স্কদের চিকিৎসার ব্যাপারে, দেহের ওষুধ গ্রহণের ক্ষমতা, ওষুধগুলোর পরস্পর বিক্রিয়া এবং সকল শারীরিক সমস্যার জটিলতার ব্যাপার মনে রেখে এগোতে হয়। বৃদ্ধের স্বাস্থ্য একবার ভেঙে গেলে, তা থেকে পুনরুদ্ধার পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সামান্য ভুলেই বৃদ্ধ জীবনও বিপন্ন হতে পারে। বৃদ্ধের চিকিৎসার ব্যাপারে অবশ্যই বার্ধক্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। দেশে, বিশেষভাবে বার্ধক্য চিকিৎসা হাসপাতাল চালু করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বার্ধক্য সৃষ্টিতে হরমোনের ভূমিকা আছে। বৃদ্ধি হরমোন কম নিঃসরণ হলেই, বার্ধক্যে আগমন দ্রুততর হবে। অনেক ক্ষেত্রে হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা করে, বার্ধক্যের কোনো কোনো লক্ষণ কমানো হয়। তবে এই ব্যবস্থা খুবই অল্পকালের জন্যই কার্যকরী করা যায়। হরমোন বিদ্যার আরো উন্নতি হলে, বার্ধক্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মেলাটোনিন হরমোনের বার্ধক্যে বিরোধী ভূমিকা আছে।
আমাদের দেহে প্রতিনিয়ত নানাবিধ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। এই সকল বিক্রিয়ায় অতি সক্রিয় ফ্রি র‌্যাডিকেল উৎপন্ন হয়। ফ্রি র‌্যাডিকেল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে বার্ধক্য আসে। বার্ধক্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বার্ধক্যবিরোধী সংগ্রামে ফ্রি র‌্যাডিকেল বিনষ্ট করতে পারে এমন খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলেছেনÑ ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘বি’, ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘ই’, বিটা ক্যারোটিন এবং সেলেনিয়াম ধাতু ফ্রি র‌্যাডিকেল বিনষ্ট করে। এই সকল ফ্রি র‌্যাডিকেল বিনষ্টকারী রাসায়নিকদ্রব্য দিয়ে তৈরি ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়। আমাদের খাদ্য গ্রহণ কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভিটামিন-ই এর ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক হতে হবে। এই সকল সতর্কতায় কিছু সময় হয়তো বার্ধক্যের আগমন টিকিয়ে রাখা হবে। তবে শেষপর্যন্ত বার্ধক্য এসেই যাবে।
একটি অদৃশ্য জীবন ঘড়ি মানুষের জীবনের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছে বলে ধরা যায়। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক, যুবক থেকে প্রৌঢ়, প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধে রূপান্তর সতত চলমান জীবন ঘড়িটি নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি এই জীবন ঘড়িকে যৌবনে পৌঁছানোর পরই থামিয়ে রাখা যায় তবে মানুষ অন্তত যৌবন নিয়ে অমরত্ব লাভ করবে। এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে, আনবিক জীবন, বিজ্ঞানী, জীন, প্রযুক্তিবিদ, হরমোন বিজ্ঞানীরা সক্রিয় হয়েছেন বলে মনে হয়। এখানে উল্লেখ্য, দেহকোষ জীনের সজ্জা বিন্যাস জীবনকে সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব এই নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। বার্ধক্যের কারণ ভালোভাবে নির্ণয় করা এবং বার্ধক্যের আগমনকে প্রতিরোধ করে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বব্যাপী গবেষণা চলছে।
বিজ্ঞানীরা সফল হলে মানুষ সুস্বাস্থ্য নিয়ে অনেক অনেক দীর্ঘজীবী হবেন। তবে বর্তমান এই বিষয়ে বিশ্ব জ্ঞান ভা-ার শুধু বার্ধক্যের আগমন কিছু বিলম্বিত করা, জীবনকে আরো বেশিদিন সচল ও সক্ষম রাখা এবং বেশি বার্ধক্যকালীন জরাগ্রস্ত থাকার সময়টুকু কমাতে সক্ষম। সংক্ষেপে বলা যায়, মানুষের বর্তমান পর্যায়ের জ্ঞানভা-ারের বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা খুবই সীমিত। তবে এই জীবনটিকে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে ফেলাই শ্রেয়।

আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট। সহ-সভাপতি প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, সিলেট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিলম্বিত বার্ধক্যের সন্ধানে
আরও পড়ুন