Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বায়ু-শব্দদূষণে উচ্চমাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি

| প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২২, ১২:২৮ এএম

জীবন ধারণের জন্য বায়ুর পরেই জরুরি হলো পানি। পানি মহান স্রষ্টার এক মহানিয়ামত। পানি ছাড়া জীবন অচল। তাই বলা হয়-‘পানির অপর নাম জীবন।’ এ কথাটি বায়ুর বেলায় বেশি খাঁটি নয় কী? পানি ছাড়া পাঁচ দিন বাঁচা সম্ভব কিন্তু বায়ু ছাড়া পাঁচ মিনিটের বেশি বাঁচা দায়। মুখ বন্ধ করে নাকটা একটু চেপে ধরুন-এর সত্যতা সহজেই বুঝতে পারবেন। আর আপনা থেকেই উচ্চরিত হবে ‘বায়ুর অপর নাম জীবন।’ তবে পানি ছাড়া সাময়িক বেঁচে থাকলেও পানির অভাবে একসময় মরণ নির্ঘাত। এ কারণে প্রতিটি জীবের জন্যই চাই বিশুদ্ধ পানি। তাই পানিকেও করা হয়েছে সহজলভ্য। মানুষের সবচেয়ে প্রিয় হলো তার জীবন। তাই সবার হৃদয় জুড়ে থাকে বেঁচে থাকার বাসনা। একটি আদর্শ শহর মানে পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট সাজানো গোছানো ভবন আর প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা নয়। এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এর বায়ু ও শব্দের মান।

রাজধানী ঢাকাতে প্রবেশ করলে একজন মানুষের কাছে এটিকে একটি বালু ও ধোঁয়ার ঝড়ে আক্রান্ত শহর মনে হবে। এর মধ্যে বিভিন্নি যানবাহন ও কলকারখানা থেকে আসা উচ্চ শব্দে তার কানে তালা লাগার উপক্রম হবে। নবাগতরা এ সমস্যায় পড়েন। এ শহরে অপর্যাপ্ত রাস্তা, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার অভাব, এর ওপর অপ্রতুল নাগরিক সুবিধা। এসব বঞ্চনার সাথে শব্দ ও বায়ুদূষণ যোগ হয়ে এর অধিবাসীদের নিয়মিত দুর্যোগকবলিত একটি এলাকার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এসব নিয়ে দেশী-বিদেশী সংস্থার করা জরিপ ও প্রতিবেদনে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা অব্যাহতভাবে বলা হলেও এ শহরের বাসযোগ্যতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ খুব কম ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে।

এক জরিপ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ঢাকা শহরের হাসপাতাল এলাকায় সর্বনিম্ন যে শব্দ পাওয়া যায়; তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি। স্ট্যাম্পফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের বায়ুম-লীর দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষকরা রাজধানীর ধানমন্ডির ১৭টি হাসপাতালের সামনে দিনের বেলার শব্দমাত্রা মাপেন। গবেষক দল প্রতিটি স্থান থেকে ৬৫টি করে নমুনা নেয়। দেখা গেছে, ৯টি হাসপাতালের সামনে শব্দমাত্রা ৮০ ডেসিবল। যেখানে গড় শব্দের মাত্রা ছিল ৮১ ডেসিবল। এসব হাসপাতালের সামনে সর্বোচ্চ ৮৯ ডেসিবল শব্দও উৎপন্ন হচ্ছে। নীরব ও আবাসিক এলাকা হিসেবে ধানমন্ডিতে শব্দের মাত্রা থাকার কথা ৫০-৫৫ ডেসিবল। সেখানে সর্বনিম্ন মাত্রা পাওয়া গেছে ৬৯ ডেসিবল। গড়পড়তা শব্দমাত্রা নয়, সর্বনিম্ন মাত্রাই নির্ধারিত মানের চেয়ে অনেক বেশি। ধানমন্ডি রাজধানীর একটি অভিজাত আবাসিক এলাকা। সেখানেই যদি এ অবস্থা হয়; রাজধানীর যানজটে নাকাল হওয়া অথবা প্রবেশমুখগুলোর পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। অন্য দিকে ঢাকার বায়ুদূষণের পরিস্থিতি আরো খারাপ। সেটি রাস্তায় বেরুলেই টের পাওয়া যায়।

বায়ুদূষণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন যৌথভাবে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠান দু’টির করা ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০২০’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এখানে স্থান পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সংস্থা দু’টির দাবি, নম্নিমানের বায়ু বাংলাদেশের মানুষের আয়ু ২ দশমিক ৯১ বছর কমিয়ে দিচ্ছে। যানবাহানের ধোঁয়া ও জীবাশান্ম জ্বালানি থেকে তৈরি হয় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ‘পিএম ২.৫’ উপাদান। প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে উপাদানটির সহনীয় মাপ ১০ মাইক্রোগ্রাম। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রতি ঘনমিটারে ‘পিএম ২.৫’-এর পরিমাণ ৭৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। স্বভাবত রাজধানী ঢাকায় অধিকতর দূষিত বাতাসে ক্ষতিকর উপাদানটি আরো বেশিই হওয়ার কথা। এটি ফুসফুসের ক্যান্সারের এজেন্ট হিসেবে শনাক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাহলে প্রতিনিয়ত আমরা যে বাতাস গ্রহণ করছি সেটা কি এক প্রকারের বিষ নয়? দেশে দ্রুত নগরায়ণ হয়েছে এবং এখনো এ প্রবণতা অব্যাহত। এখানে পরিকল্পনার কোনো ছাপ নেই। প্রয়োজনীয় রাস্তা ও নাগরিক সুবিধার কথাই কেউ ভাবছেন না। সেখানে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ নিয়ে চিন্তা দূরপরাহত।

লক্ষণীয়, আমাদের মধ্যে রোগবালাইয়ের মহামারী অবস্থা বিদ্যমান। হাসপাতালগুলোতে সব সময় ভিড় লেগেই থাকে। এ ছাড়া বিপুল জনগোষ্ঠী উপযুক্ত চিকিৎসা পাচ্ছে না। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের একটু সতর্কতা ও আন্তরিকতা থাকলে পরিস্থিতি ভিন্নতর হতে পারত। অর্থাৎ নানামাত্রিক দূষণের বিষয়টি মাথায় রেখে নগরায়ণ ও সম্প্রসারণ করলে অন্তত হাসপাতালে থাকা রোগীদের উচ্চমাত্রার শব্দে বিপদগ্রস্ত হতে হতো না। আবার বাসার মধ্যে বসে ক্ষতিকর দূষণ ‘পিএম ২.৫’ এ আক্রান্ত হতে হতো না। এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। আমরা এখন থেকে উদ্যোগ নিলে উন্নত নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে পারি যেখানে বায়ু শুদ্ধ করে নেয়া যেতে পারে অনায়াসে। থাকবে না উচ্চমাত্রার শব্দদূষণও। ঢাকা থেকেই এ উদ্যোগের শুভসূচনা হতে পারে। ক্রমান্বয়ে সারা দেশের সব বড় শহর পরে নগর-বন্দর এমনকি গ্রামও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ব্যাপারে দ্রুত কিছু না করলে সামনে সমূহ বিপদ।

মো: লোকমান হেকিম
শিক্ষক-কলামিস্ট।
মোবাইল: ০১৭১৬-২৭০১২০



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বায়ু-শব্দদূষণে উচ্চমাত্রার স্বাস্থ্যঝুঁকি
আরও পড়ুন