Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

পাটের বহুমুখী সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২২, ১২:০৪ এএম

পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। বাংলাদেশ বিশ্বে সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে পরিচিত। এই সোনালি আঁশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রতিবছর ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস উদযাপন করা হয়। এবছর দিবসটির স্লোগান ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ, পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ।’ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বস্ত্র ও পাট খাতের সম্মিলিত অবদান সর্বাধিক। তাছাড়া, কৃষি খাতেও পাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মায়ানমার, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, ব্রাজিল এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি দেশে পাটের আবাদ হয়। পাটের বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ এক সময় একচেটিয়া সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং ১৯৪৭-৪৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে এদেশ থেকে প্রায় ৮০% পাট রপ্তানি হতো। ১৯৭৫-৭৬ সাল নাগাদ এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে এবং বর্তমানে বিশ্ব চাহিদার শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ পাট বাংলাদেশ থেকে বাইরে যায়। এ অবনতির বড় কারণ পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাব।

ধান ও গম বাংলাদেশের প্রধান দুটি খাদ্যশস্য। কিন্তু বছরের পর বছর একই জমিতে ধান এবং গমের আবাদ করা হলে পরিবেশগত দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি হয়। ধান ও গমের শিকড় ৩-৪ ইঞ্চির বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তাছাড়া শিকড়ের নিচে একটি শক্ত আস্তরণ সৃষ্টি হয় যার নিচে গাছের খাদ্য উপাদান জমা হয়। কিন্তু ধান ও গমের শিকড় সেখানে পৌঁছাতে পারে না। তবে এর উপরের স্তরের খাদ্য উপাদান নিঃশেষিত হয়ে যায়। এ অবস্থায় ফসল- চক্রে পাট চাষ করা হলে পাটের ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা শিকড় মাটির তলার শক্ত আস্তরণ ভেঙ্গে ফেলে এবং নিচের স্তর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। আরো জানা যায় যে, পাটগাছ যে খাবার খায় তার ৬০% মাঠে দাঁড়ানো অবস্থায় পাতা ঝরানোর মাধ্যমে মাটিতে ফিরিয়ে দেয়। তাই ধান, গম এবং অন্যান্য ফসলের আবাদ টিকিয়ে রাখতে হলে পাট চাষ অবশ্যই করতে হয়।

প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশের পাট ও বস্ত্র শিল্পের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বস্ত্র ও পাট শিল্প সুদূর অতীত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪% এবং জিডিপি’র প্রায় ১২% অর্জিত হয় বস্ত্র ও পাটখাত থেকে। দারিদ্র বিমোচন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও এ দু’টি খাতের অবদান অনস্বীকার্য। পাটের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯০০ সালে ভারত সরকার তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার জন্য একজন পাট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন। এ গবেষক এবং তাঁর সহকর্মীরা পরবর্তীতে কয়েকটি উন্নতজাতের পাট উদ্ভাবন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাকিয়া বোম্বাই, ডি১৫৪ এবং চিনসুরা গ্রিন। ১৯৩৮ সালে ঢাকায় সর্বপ্রথম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পাট গবেষণাগার ইন্ডিয়ান জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রায় একই সময়ে কলকাতার টালিগঞ্জে একটি প্রযুক্তি গবেষণাগারও স্থাপিত হয়। পাট চাষ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাদেশিক সরকার ১৯৪০ সালে জুট রেগুলেশন ডাইরক্টরেট স্থাপন করে। এ অধিদপ্তর পাটচাষ, উৎপাদন এবং চাষ এলাকা নির্ধারণসহ পাটচাষের জন্য চাষী নির্দিষ্ট করার দায়িত্বও পালন করত। ১৯৪৯ সালে পাট ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকির জন্য পাকিস্তান সরকার জুট বোর্ড গঠন করে। ১৯৫১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাট কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৫৭ সালে তেজগাঁও-এ একটি পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ঢাকার শেরে-বাংলা নগরে মানিক মিঞা এভিনিউ-এ অবস্থিত এই গবেষণাগার বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র পাট বিভাগ গঠিত হয়। পরে ১৯৭৬ সালে এ বিভাগ পূর্ণ মন্ত্রণালয়ের রূপ নেয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পাট সংস্থার প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত। সংস্থাটির বর্তমান নাম ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপ। পাট দ্বিবীজপত্রী আঁশযুক্ত উদ্ভিদ। বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাট আঁশ প্রধানত দুটি প্রজাতি, সাদাপাট ও তোষাপাট থেকে উৎপন্ন হয়। সাদা ও তোষা পাটের উৎপত্তিস্থল যথাক্রমে দক্ষিণ চীনসহ ইন্দো-বার্মা এবং ভূমধ্যসাগরীয় আফ্রিকা।

পাট চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু বাংলাদেশের গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যমান থাকায় ওই সময়েই এর আবাদ হয়। উচ্চ তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, পরিচ্ছন্ন আকাশ পাটের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক। দেশি পাটের চেয়ে তোষাপাট কিছুটা পরে বুনতে হয়। তবে জমিতে জুন-জুলাই মাসে পানি জমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সে জমিতে পাট কিছুটা আগাম বপন করা উচিত। পাটের বৃদ্ধির জন্য দীর্ঘ আলোক-দিবসের প্রয়োজন। বীজবপনের পর আঁশের জন্য ফসল তুলতে ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগে। ফুল আসার সময়ই পাট কাটতে হয়। আঁশ পাওয়া যায় কান্ডের বাস্ট বা ফ্লোয়েম স্তর থেকে। পাটচাষ শ্রমঘন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাষিরা প্রান্তিক, দরিদ্র ও ক্ষুদ্র খামারি। সফল চাষাবাদের জন্য জমি প্রস্তুত খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাটির ধরন অনুযায়ী সাধারণত নাইট্রোজেন-ফসফরাস-পটাশিয়ামের যথানুপাতে গোবরও ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতে পাট উৎপন্ন হলেও ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুঢ়া ও জামালপুরই প্রধান পাটচাষ অঞ্চল। পাটচাষাধীন মোট জমির পরিমাণ প্রায় ২,২৬,৬৫৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৪০,৩৪,৫৮৯ বেল। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ২৭টি উচ্চফলনশীল ও উন্নত মানের পাটের জাত উদ্ভাবন করেছে। পাট তিন পর্যায়ে বাজার জাত করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ছোট ছোট বাজারে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বড় বড় বাজারে এবং তৃতীয় পর্যায়ে দেশীয় পাটকলসমূহে এবং বিদেশি বাজারে। কৃষকের হাত হতে একটি বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে পাট রপ্তানি করা হয়। মার্কেটিং প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা জড়িত রয়েছে। এ ব্যবস্থায় ফড়িয়া, বেপারী, আড়তদার, দালাল, কাঁচাবেলার ও পাকা বেলাররা জড়িত থাকে।

পাট পরিবেশবান্ধব, বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। বস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পাট এখনও গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সঙ্গে মিশ্রণ করে ব্যবহার করা যায়। প্রচলিত বয়ন শিল্পে পাটের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং ইত্যাদি। পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, ইত্যাদি পাট থেকে তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরীর জন্য উলের সঙ্গে মিশ্রণ করা হয়। কৃষি পণ্য এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য ব্যাপকভাবে পাট ব্যবহার করা হয়।


বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহূত হওয়ার আগে পাট পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রশি, হাতে তৈরি কাপড়, শিকা ও গৃহসজ্জার সামগ্রীসহ গৃহস্থালি ও খামারে উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগে বাংলায় পাটজাত দ্রব্যের মধ্যে ঘানিবস্তা ও পাটশাড়ির বহুল ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। আঠারো শতক থেকে বিদেশে গানিব্যাগ রপ্তানি হয়েছে। পাটের পাতা ও মূল স্থানীয় লোকেরা ভেষজ ও সবজি হিসেবে ব্যবহার করে। শণের বিকল্প হিসেবে পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার আরম্ভ হয় পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত ডান্ডিতে।

পাটখড়ি পাট চাষের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। পাট আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ খড়ি উৎপাদিত হয়। ঘরের বেড়া, ছাউনী এবং জ্বালানি হিসাবে খড়ির ব্যবহার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি। পাটখড়ি জ্বালানি, ঘরের বেড়া, ঘরের চালের ছাউনীতে ব্যবহার হয়। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসাবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মন্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটখড়ি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় পাটের কচি পাতাকে শাক হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমেদ খান। লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাট


আরও
আরও পড়ুন