Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

মে’রাজুন্নবীর তাৎপর্য

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২২, ১২:০৮ এএম

মে’রাজুন্নবী বিশ্বের সর্বাধিক বিস্ময়কর ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। তওহীদের ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে মেরাজ রজনীর অলৌকিক রহস্যময়, অসীম খোদায়ী কুদরতের নিদর্শনাবলী। এ রহস্যময় ঘটনাবলীর একটি মাত্র উদাহরণ নিয়েই আমাদের এ আলোচনা। তা হচ্ছে: রসূলুল্লাহ (সা.) যখন মেরাজ হতে যাত্রাস্থলে প্রত্যাগমন করেন তখনও তাঁর পবিত্র বিছানা যথারীতি গরম ছিল এবং গৃহের দরজার কড়া-চাবিও স্বাভাবিক নড়াচড়া করছিল। অথচ, হুজুর (সা.) জ্ঞাত স্থান থেকে অজ্ঞাত স্থানে সফর করে এসেছেন এবং এ দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও তাঁর বিছানা গরম থাকা এবং দরজার কড়া নড়তে থাকা ও ওজুর পানি গড়াতে থাকা সাধারণ বুদ্ধিবিবেচনায় বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার বিষয় নয়। হযরত উম্মে হানী (রা.) এর গৃহ হতে ফেরেশতার সঙ্গে করে আনা বোরাকে আরোহণ করে বিভিন্ন স্থানে গমনের পর তিনি মসজিদে আকসায় পৌঁছেন এবং সেখানে আম্বিয়ায়ে কেরামের নামাজে ইমামতি করার মাধ্যমে দুনিয়ার সফরের প্রথম পর্ব শেষ করেন, যাকে বলা হয় ‘ইসরা’। অতঃপর মেরাজের ঘটনা, যার সূচনা হয় মসজিদে আকসা হতে। এ মহাজাগতিক সফরের প্রথম পর্ব প্রথম আসমান হতে সপ্তম আসমান পর্যন্ত, সকল আসমানে প্রসিদ্ধ নবীগণের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ এবং প্রত্যেক আসমানে আল্লাহর বহু অদ্ভুত রহস্য, নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার পর ‘সিদরাতুল মোন্তাহা’ নামক অদৃশ্য জগতে উপনীত হওয়া এবং সেখান হতে হযরত জিব্রাঈল (আ.) এর অপরাগতা প্রকাশ করে বিদায় গ্রহণ পর্যন্ত সর্বসাকূল্যে কত সময় অতিবাহিত হতে পারে সেটা যেমন বড় প্রশ্ন, তেমনি আরো প্রশ্ন জাগে যে, সিদরাতুল মোন্তাহা হতে রসূলুল্লাহ (সা.)কে স্বশরীরে আরেকটি রহস্য জগতে নিয়ে যাওয়া হয়, যাকে বলা হয় ‘কাবাকাওসাইন’। আর এখানেই তিনি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন।

স্থান-কালের এ অজানা রহস্যেও খোদার অসীম কুদরত ‘কুন ফায়াকুনে’র প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের যে সবক আছে, সূরা ‘ইসরা’তে তার জাহেরী এবং সূরা ‘নজমে’ বাতেনী ইঙ্গিত রয়েছে। কোরআনের ভাষ্যকারগণ হাদীস ও বিভিন্ন সূত্রে এগুলোর বিশদ বিবরণ প্রদান করেছেন। সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির ঊর্ধ্বে এ মহাজাগতিক এসব রহস্য উদঘাটনের কথাতো ভাবাও যায় না, এমনকি মহাজাগতিক রহস্যাবলী উদঘাটনে এবং এগুলোর গতি-প্রকৃতি ও পরিবর্তন-বিবর্তনে নির্ধারিত ও স্থিরকৃত নীতিমালা বিশারদ, বিশেষজ্ঞ, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের চিন্তা গবেষণাও এক্ষেত্রে অচল হয়ে যায়। স্থানকাল নিয়ন্ত্রণের এ অসমাধানযোগ্য জটিল রহস্য উদঘাটনে কোরআন উদ্ভাবিত সহজীকরণ পদ্ধতিতে যে পরিসংখ্যান বা সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাব দেয়া হয়েছে, তার সংক্ষিপ্ত রূপ এই: আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর একদিন আর আমাদের এক হাজার বছরের সমান (৪৭-২২)। অপর এক স্থানে আল্লাহর একদিনকে আমাদের পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান বলা হয়েছে (৪-৭০)।

বিভিন্ন হাদীসে দূরত্বসমগ্রকে মাইলে বিভক্ত করার পরিবর্তে বর্ষসমূহের পথ বলা হয়েছে। তাই এই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ব্যাপক সংখ্যাক হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানীরা দশ লাখকে এক মিলিয়ন বলতে থাকেন এবং আটান্ন (৫৮) ‘খরব’। প্রতি খরবে (দশ হাজার কোটি) মাইলের দূরত্বকে আলোকবর্ষ গণনা করেন। ‘নুরি বর্ষ’ নামে আখ্যায়িত বিজ্ঞানীদের আলোকবর্ষ তাদের পরিমাপ পদ্ধতি। পৃথিবীর প্রশস্ততা ব্যাপকতা ও ব্যাস পরিমাপের জন্য অর্থাৎ গতি নির্ধারণের জন্য তারা নির্ধারণ করেন প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল। বোরাক বা বিদ্যুতের গতির জন্য একটি নূরানী বা আলোক সময়ের প্রয়োজন ছিল এবং অসীম কুদরতের অধিকারী স্রষ্টা এ বৈদ্যুতিক শক্তিকে যে কাজে নিয়োজিত করেছিলেন, তাকে দ্রুতগতিসম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়াও দ্রুতগতির কতিপয় দৃষ্টান্ত মানুষের সামনে রয়েছে। যেমন বলা যায়, একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব ১৮৬০০০ মাইল দূরত্বে রেখে সুইস টিপলে এক সেকেন্ডে তা জ্বলে উঠবে। এটি বিদ্যুৎ প্রবাহের দ্রুতগতি। অতঃপর বাতাসের দ্রুতগতিও একটি উদাহরণ হতে পারে।

এবার মেরাজের কথায় আসা যাক! মেরাজ রজনীতে রসূলুল্লাহ (সা.) বোরাক হতে অবতরণের পর কী পরিস্থিতি ছিল? বর্ণনা অনুযায়ী, তখন তিনি মসজিদে আকসায় প্রবেশ করেন এবং পয়গম্বরগণের একটি জামাত তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করার জন্য আগমন করেন এবং হুজুর (সা.) ইমাম হয়ে তাদেরকে নামাজ পড়ান। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আ.) হুজুর (সা.)কে ‘কোব্বাতুস সাখরা’ বা সাখরা গম্বুজে নিয়ে যান, সেখানে হুজুর (সা.) একটি সিঁড়ি দেখতে পান, যা জমিন হতে আসমান পর্যন্ত ব্যাপৃত ছিল, এটি ছিল মেরাজে উঠার খুবই রহস্যময় মাধ্যম। সীরাত লেখকগণের পরিভাষায় ‘ইসরা’ এর ধাপ শেষ হয় এই সিঁড়ির নিকটে, এতে উঠতেই শুরু হয় ‘মেরাজ পর্ব’।

হুজুর (সা.) যে বোরাকের উপর আরোহণ করে বায়তুল মোকাদ্দাসে গমন করেন তার পরিচয় তুলে সীরাত লেখকগণ চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। বিবরণে বলা হয় যে, দুই পালক বিশিষ্ট বোরাকটি ছিল অতি সুন্দর, চমকদার। তার বক্ষ ছিল সুর্খ ইয়াকুত পাথরের ন্যায় চমকদার, পৃষ্ঠে ছিল সুর্র্খ ইয়াকুত পাথরের গদি, মস্তকে ছিল মণি-মুক্তা জড়ানো মুকুট, লাগাম ছিল পান্না পাথর খচিত এবং দুই পাশে ছিল ঝুল, মূল্যবান পাথরের জিন এবং কপালে লেখা ছিল, ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’।

অতঃপর শুরু হয় মেরাজের ঘটনা! প্রথম আসমান হতে সপ্তম আসমান অতিক্রম করার পর ‘সিদরাতুল মোন্তাহা’ পর্যন্ত পৌঁছানোর বিবরণ কোরআন ও হাদীসে রয়েছে। এর পরবর্তী বিবরণ সূরা নজমে বিদ্যমান, যাকে ‘কাবাকাওসাইন আও আদনা’ বলা হয়। বিভিন্ন তফসীরি ভাষ্য অনুযায়ী, এ আয়াতের মাধ্যমে হুজুর (সা.) এর আল্লাহর সান্নিধ্যে আসার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্রে সিদরাতুল মোন্তাহার পরবর্তী রহস্যময় ঘটনাবলীর বিবরণ আরো আশ্চার্যজনক। মেরাজের এ পর্যায়ে বহু বিস্ময়কর হিজাব-প্রাচীর, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি অতিক্রম করার এবং ফেরেশতা মিকাইল (আ.), ইস্রাফীল (আ.) এবং হযরত আজরাঈল (আ.) ও ‘রফরফ’ নামক সোওয়ারের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সর্বশেষে হুজুর (সা.) গায়বী আওয়াজ শুনতে পান, হে আমার হাবীব! সামনে অগ্রসর হোন! আরো নিকটবর্তী হোন, আরো নিকটবর্তী, আরো নিকটবর্তী। সব দূরত্ব অতিক্রম করার পর ‘কাবা কাওসাইনে আও আদনা’ তথা নির্জন স্থানে পৌঁছে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন।

হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রা.) বলেন, হুজুর (সা.) তাঁর প্রভুর এতই নিকটবর্তী হলেন যে, আল্লাহ ও তাঁর হাবীবের মাঝখানে এক কামান পর্যন্ত দূরত্ব ছিল। তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তা’আলা এটাই যথেষ্ট মনে করলেন না এবং তাঁর হাবীবকে বললেন, এর চেয়েও নিকটবর্তী হোন।

বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী, কাবা কাওসাইনে পৌঁছার পর রসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি এক অপূর্ব তোহফা দান করা হয়, যা মোমেন মুসলমানগণ প্রত্যেক নামাজে পাঠ করে থাকেন এবং তা হচ্ছে ‘আত্তাহিয়্যাত-আস্সালামু আলাইকা আইয়্যুহান্নাবীয়্যু, ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু!’ পাঞ্জাগানা নামাজও মেরাজ রজনীর উপহার।

মেরাজ হতে প্রত্যাবর্তনের পর হুজুর (সা.) এর বিছানা গরম থাকা আল্লাহর কুদরতি শক্তি ‘কুন-ফায়াকুনে’র নির্দেশের প্রতিফলন। কুন-ফায়াকুনের এ রহস্য বিজ্ঞান উদঘাটন করতে সক্ষম নয়, তবে বিজ্ঞানের ক্রমোন্নতির ফলে বিজ্ঞানীরা রসূলুল্লাহ (সা.) এর মেরাজের রহস্যাবলীর সমর্থন ও স্বীকার করতেই থাকবেন। মেরাজের ঘটনা আল্লাহর কুদরত ও অভিনবত্বের নির্দশন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মে’রাজুন্নবীর তাৎপর্য
আরও পড়ুন