Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

পশ্চিমা পাপেট জেলেনস্কির অপরিণামদর্শিতা এবং ইউক্রেনে রুশ সমরাভিযান

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২২, ১২:১১ এএম

রাশিয়ার ইউক্রেন দখল এই মুহুর্তে বিশ্বের প্রধান আলোচ্য বিষয়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর কোনো বড় শক্তির আগ্রাসন মেনে নেয়ার বিষয় নয়। তবে আমেরিকা যেভাবে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক-আফগানিস্তান দখল করে নিয়েছিল, শুধুমাত্র নিজেদের অনুগত-বশংবদ না হওয়ায় পশ্চিমা ন্যাটো জোট সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনে প্রক্সি যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু লাখ লাখ মানুষকে উদ্বাস্তুতে পরিনত করে এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে রাশিয়া-ইউক্রেনের বিষয়টা তেমন নয়। এখানে দুই প্রতিবেশির মাঝখানে রাশিয়ার বিপক্ষে সেই ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তির নানা ধরণের ইন্ধন ও উস্কানিমূলক কর্মকান্ডই শেষ পর্যন্ত রাশিয়াকে ইউক্রেনে সামরিক হামলায় বাধ্য করা হয়েছে। ভিন্নভাবে বললে, রাশিয়ার সীমান্তে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার পায়তারা এবং রাশিয়ার উপর বড় ধরণের নিরাপত্তা হুমকি জনক চাপ সৃষ্টির তৎপরতাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর দখলদারিত্ব কায়েম করতে সামরিক হামলার সুযোগ গ্রহণ করেছে। রাশিয়া সামরিক শক্তিতে যত বলিয়ানই হোক, ইউক্রেনের ইউরোপ-আমেরিকা ঘনিষ্টতা এবং তাদের অব্যাহত হুমকির প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দুর্বল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ রাশিয়াকে তার দুর্বলতাগুলোও ভাবতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের আশঙ্কার কথা বলার পরও রাশিয়ার তরফ থেকে তা অস্বীকার করা হয়েছিল। অতিমাত্রায় মার্কিন ঘনিষ্ট ইউক্রেনের ইহুদি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ভাবসাব দেখে সেখানে ন্যাটো বাহিনীর সামরিক উপস্থিতির আশঙ্কা করেই ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর কথা বলা হচ্ছিল। এরই মধ্যে বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ইউক্রেনের পূর্বাংশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চল লুহানস্ক ও ডোনেটস্কের রুশপন্থী বিদ্রোহীরা সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। লুহানস্ক ও ডোনেটস্কের মূলত রুশ ভাষাভাষি ও রুশ বংশোদ্ভুত নাগরিকদের এই বিদ্রোহের পেছনে রাশিয়ার সমর্থন ও সহযোগিতা সব সময়ই ছিল। কিয়েভের রাশিয়া বৈরী সরকারকে শায়েস্তা করতে এর আগে ২০১৪ সালে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী ইউক্রেনের কৌশলগত অঞ্চল ক্রিমিয়ায় রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের একইভাবে উস্কানি দিয়ে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে তা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। সে সময়ও ন্যাটোসহ পশ্চিমাদের হম্বিতম্বি ইউক্রেনের পক্ষে কোনো কাজে আসেনি। আঞ্চলিক ও আভ্যন্তরীণ বাস্তবতা উপেক্ষা করে ন্যাটো ও পশ্চিমা বন্ধুদের ইন্ধনে আট বছরের মাথায় আবারো ভাঙ্গনের মুখে পড়ল ইউক্রেন। লুহানস্ক ও ডোনেটস্কের বিদ্রোহীরা জেলেনস্কির বাহিনীকে হটিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এই দুই বিদ্রোহী অঞ্চলকে পিপলস রিপাবলিক হিসেবে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ঘোষণা করেন। শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে দূরের কোনো অঞ্চলকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মূলত রুশপন্থী ও রুশবংশোদ্ভুতদের সমর্থন দিয়ে এ ক্ষেত্রে রাশিয়া অনেকটা এগিয়ে আছে।

সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যে কয়টি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় ইউক্রেন তার অন্যতম। রাশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার পারমানবিক বোমার এক বড় অংশের মজুদ ছিল ইউক্রেনে। ১৯৮৬ সালে ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমানবিক কেন্দ্রের ভয়াবহ দুর্ঘটনা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর স্বাধীন ইউক্রেনে যে পরিমান পারমানবিক বোমার মজুদ ছিল, অস্ত্রের সংখ্যা হিসেবে তা ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমানবিক শক্তি। তবে ইউক্রেনের স্বাধীনতার শর্তই ছিল পারমানবিক অস্ত্র রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করা এবং নন-প্রলিফারেশন চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। সে সব শর্ত মেনেই ইউক্রেন রাশিয়া সীমান্তে পূর্ব ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদি বিশ্বের সাথে চীন ও রাশিয়ার মত সাবেক সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তিগুলো বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খাপখাইয়ে চলার চেষ্টা করলেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা কখনোই এসব দেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে দিতে চায়নি। নানা অজুহাতে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক দেশে সামরিক আগ্রাসন চালালেও চীন-রাশিয়ার পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হয়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া ও আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের পেছনে রাশিয়া, চীন ও ইরানের নেপথ্য ভ’মিকা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ইতিপূর্বে সোভিয়েত আমলে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসেও সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুবিধা করতে পারেনি। জাতীয় ঐক্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট বলিষ্ঠতার সাথেই টিকে আছে কিউবা।

পরাশক্তির পক্ষ-বিপক্ষের মেরুকরণ যাই হোক, শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিভাবে ঐক্যবদ্ধ কোনো জাতিকে পরাস্ত করা যায়না। ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইয়েমেন তার জ্বলন্ত প্রমান। পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলেও সঠিক নেতৃত্ব না থাকা, শাসকের নিবুর্দ্ধিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার কারণে যে কোনো জাতির জীবনে রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। ভারতের কাশ্মির ও সিকিম তার অন্যতম উদাহরণ হতে পারে। বৃটিশদের শেষ আদম শুমারি অনুসারে, অবিভক্ত কাশ্মিরে সাতাত্তুর শতাংশ মানুষ ছিল মুসলমান এবং ২০ শতাংশ হিন্দু। সেই কাশ্মিরের রাজা শিখ ধর্মাবলম্বি হরিসিং ভারতের সাথে আঁতাত করে শত শত বছর ধরে স্বাধীন ও প্রিন্সলি স্টেট জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতের হাতে তুলে দেন। একইভাবে সংসদে আইন করে স্বাধীন সিকিম রাজ্যের স্বাধীনতা ভারতের কাছে বিকিয়ে দিয়েছিল সিকিমের শেষ স্বাধীন রাজা নামগয়াল লেন্দুপ দর্জি। মিরজাফরের পর লেন্দুপ দর্জির নাম ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সমভাবে উচ্চারিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রনীতির জটিল বিষয়গুলোকে সব সময় একই সুত্রে ব্যাখ্যা করা চলে না। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভেঙ্গে একটি ভারসাম্যহীন ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে শেষ সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচেভের ভ’মিকা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠছে। একইভাবে দেশপ্রেমের বাড়ন্ত দেখিয়ে ন্যাটো ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ক্রীড়নকে পরিনত হয়ে ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজের দেশকে প্রবল প্রতিবেশি রাশিয়ার ভ’রাজনৈতিক টাগের্টে পরিনত করতে বাধ্য করেছেন বলেই হয়তো আগামি দিনের ইতিহাসে লেখা হবে। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ান সামরিক আগ্রাসন শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যেই রাজধানী কিয়েভের পতন এবং দুই দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনার প্রস্তাবকে ইতিবাচক বলেই ধরে নেয়া যায়। হাজার হাজার রাশিয়ান সেনা হত্যার দাবি এবং ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিনকদের দেশরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়া এবং মরণপণ লড়াইয়ের যে সব ইতিহাস রচিত হচ্ছে তাও বাকি দুনিয়ার আগ্রাসি শক্তির জন্য অশনি সংকেত। ইউক্রেন ও রাশিয়ান প্রতিনিধিরা যখন বেলারুশে শান্তি আলোচনায় সম্মত হয়েছে, তখন ন্যাটো ও পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউক্রেনে বড় অংকের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দিচ্ছে। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ইউক্রেন আলাদা রাষ্ট্র হয়েছে, রাশিয়া তা মেনে নিয়েই পাশাপাশি পথ চলছিল। সেখানে রাশিয়ান প্রভাব থাকা স্বাভাবিক হলেও তা আধিপত্যবাদী হয়ে উঠেনি। ইউক্রেনে বশংবদ ও অপরিনামদর্শি শাসক বসিয়ে পশ্চিমারা ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়ার নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়ার যে নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল, তা ইউক্রেন এবং ন্যাটোর জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন রাশিয়ার উপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও ইউক্রেনের হাতে আরো অস্ত্র দিয়ে রাশিয়াকে হটিয়ে দেয়া সম্ভব না হলেও যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে ইউক্রেন ও রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসের মাধ্যমে সেখানে অর্থনৈতিক আধিপত্য আরো পাকা করার চেষ্টা চলতে পারে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আর যাই হোক, পশ্চিমা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের লাভ। এভাবে যুদ্ধমান দেশকে ঋণের ফাঁদে ফেলে তার স্বাধীনতার উপর নগ্ন হস্তক্ষেপের ইতিহাসও সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। ইরান-ইরাক যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করা, সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে ঋণের ফাঁদে ফেলা এবং কুয়েত দখলে উদ্বুদ্ধ করার পর প্রথমে গাল্ফ ওয়ার, অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অত:পর ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশনের মিথ্যা অভিযোগে ইরাক দখলের ইতিহাস এখন অনেকটাই স্পষ্ট।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের ৫দিনের মাথায় মধ্যস্থাকারীদের শান্তি আলোচনার প্রস্তাব ইউক্রেনিয়ান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রথমে প্রত্যাখ্যান করলেও বেলারুশের সীমান্তবর্তী শহর গোমেলে সোমবার এই আলোচনার শুরুতেই দুই পক্ষকেই নিজেদের লক্ষ্য ও শর্তে অনঢ় অবস্থানে দেখা যায় এবং কোনো সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়। আল জাজিরার সংবাদদাতা সোমবার দুপুরে শান্তি আলোচনার ভবিষ্যত সম্পর্কে অনিশ্চয়তা পোষণ করেন। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী পাঁচ দিনে ৫ হাজারের বেশি রুশ সেনা হত্যার দাবি করেছে। হতাহতের সংখ্যা নিয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে তেমন কোনো তথ্য জানানো হয়নি। কয়েক ঘন্টার মধ্যে কিয়েভ দখলের প্রত্যয় ঘোষণা করার পর ৫ দিনে প্রচুর মূল্য দিয়ে হলেও রাশিয়ার ইউক্রেন দখল অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছে। এখন শান্তি আলোচনায় দুই পক্ষ তাদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে মধ্যপন্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছা এখনো সম্ভব হতে পারে। সেনা অভিযানের নির্দেশ দেয়ার আগে রাশিয়ার গণমাধ্যমে দেয়া ভাষনে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, ‘ইউক্রেন আমাদের কাছে শুধুমাত্র প্রতিবেশিই নয়, এটা আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আত্মিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদের কমরেড... আমাদের পরিবার। ইউক্রেনের জনগণের সাথে আমাদের রয়েছে পারিবারিক ও রক্তের সম্পর্ক।’ রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের এই ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের এই সম্পর্কের মূল্য ও বিশ্বস্ততাকে রক্ষা করতে ব্যর্থতার দায় কার? রাশিয়ার সাথে ন্যাটো ও পশ্চিমাদের চিরস্থায়ী বৈরীতার মধ্যে প্রতিবেশি হিসেবে ইউক্রেন কি যথাযথ ভ’মিকা রেখেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানো খুব কঠিন বিষয় নয়। কিয়েভে পশ্চিমা পাপেট সরকারের অতিমাত্রায় দেশত্মবোধ কি শেষ পর্যন্ত নাজি রিজিমের মত ঔদ্ধত্ব্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল? ভ্লাদিমির পুতিনের কণ্ঠে কিন্তু তেমন কিছুই শোনা গিয়েছিল। তিনি নাৎসীবাদি রিজিম বদলের কথা বলেছেন। রাশিয়ার পক্ষ থেকে জেলেনস্কির রিজিম বদলের শর্ত কিয়েভ প্রতিনিধিরা হয়তো মানতে পারবে না। এভাবে শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হয়ে দুই পক্ষ হয়তো যুদ্ধের মাধ্যমেই চুড়ান্ত সমাধান খুঁজবে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনীদের ভ’মি দখল করে একটি ইহুদি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নিরাপত্তাহীনতা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ের সাথে ভ’-রাজনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্য থাকায় স্নায়ুযুদ্ধের সময় অন্য দেশের উপর কোনো পরাশক্তি এতটা আগ্রাসি ও নগ্ন হস্তক্ষেপ না করলেও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ার পর থেকে একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। অবশ্য এর আগে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলবাজির নজির রয়েছে। মূলত আফগানিস্তান দখল এবং আফগান মুজাহিদদের কাছে পরাজয় সোভিয়েতের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। তারাও মিথ্যা অজুহাতে ইরাক- আফগানিস্তান দখল করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট খরচ করে সেখান থেকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এবার রাশিয়ার ইউক্রেন দখলের পটভ’মি সৃষ্টির পর পশ্চিমারা রাশিয়াকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধত্তোর অটোমান সাম্রাজ্য অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর জার্মানির অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইছে। গত দুই দশক ধরে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে যে ওয়ার গেম ও মানচিত্র বদলের নীলনকশা সাজিয়েছিল ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইয়েমেনে পরাজয়ের কারণে তা কার্যত ভেস্তে গেছে। পূর্ব-পশ্চিমের ভ’রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা এবং পশ্চিমা আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে এসব যুদ্ধের চুড়ান্ত টার্গেট ইরান, রাশিয়া এবং চীন। ইরানের সাথে ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতাএবং জটিল ভ’-রাজনৈতিক সমীকরণের প্রেক্ষাপটে এবার মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে গিয়ে ইউক্রেনকে ঘিরে এবার সরাসরি রাশিয়ার মুখোমুখি দাড়িয়েছে পশ্চিমারা। ইতিমধ্যেই সর্বাত্মক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে। ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধেও পশ্চিমারা এই অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এতে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ মানবিক বিপর্যয় ও দারিদ্র্যের সম্মুখীন হলেও পশ্চিমারা নিজেদের রাজনৈতিক-সামরিক ব্যর্থতা ঢাকতে পারেনি।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো রাশিয়ার তথাকথিত প্রোপাগান্ডা ও ডিজ-ইনফরমেশন সম্পর্কে বেশ জোরালো ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। এই ক্যাম্পেইন তাদের নিজস্ব চেহারাই যেন তুলে ধরেছে। ইরাকের ডাব্লিওএমডি, আফগানিস্তানের তালেবানদের আলকায়েদা সংশ্লিষ্টা, সিরিয়ার রিজিম চেঞ্জ, আইএস জুজু ইত্যাদি নিয়ে যে সব প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছিল তার আশি শতাংশই ছিল মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে। ডিজইনফরমেশনের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য আড়াল করে গোপন অভিসন্ধি হাসিল করাই এসব প্রোপাগান্ডার মূল লক্ষ্য। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমন আর আমেরিকার ইরাক-আফগানিস্তান দখল একই মাপের বিষয় নয়। রাশিয়া তার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে সীমান্তবর্তী দেশে হামলা চালিয়েছে যা’ সমর্থনযোগ্য নয়। মহাদেশ-মহাসমুদ্র পেরিয়ে এসে আমেরিকার ধারাবাহিক দেশ দখলের সাথে তা তুলনীয় নয়। আমেরিকার সে সব দেশ দখলের সময় পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর ভূমিকা কি ছিল? তাদের মিস-ইনফরমেশন এবং ডিজ-ইনফরমেশন ক্যাম্পেইন ও প্রোপাগান্ডার মূল লক্ষ্যই ছিল ভিকটিমদের ডেমোনাইজ করা। সেই ইংরেজী প্রবাদটি স্মরণ করা যেতে পারে- ‘গিভ দ্য ডগ অ্যা ব্যাড নেইম অ্যান্ড কিল ইট’। গত বছর ইসরাইল যখন ফিলিস্তিনে ডিসপ্রোর্পশনেট বিমান হামলা চালাচ্ছিল, তখন ইউক্রেনের ইহুদি জায়নবাদী প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইসরাইলকেই ফিলিস্তিনী আক্রমনের ভিকটিম বলে টুইট করেছিলেন। তার সেই টুইটের জবাবে একজন মুসলমান যুবক মন্তব্য করেছিল, যেদিন কিয়েভের উপর রাশিয়ান বিমান হামলা হবে সেদিন বুঝবেন। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তা চাক্ষুষ করতে হচ্ছে জেলেনস্কিকে। আর আঘাতটা রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউরোপের একটি দেশে হওয়ায় পশ্চিমা মিডিয়াগুলো রাশিয়ার ডিজইনফরমেশন নিয়ে কথা বলছে। সাত দিনের ইউক্রেন যুদ্ধে, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট, জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর, ইত্যাদি সংস্থাগুলোর যে প্রতিক্রিয়া ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে,দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিন, ইরাক-আফগানিস্তান, সিরিয়া,লিবিয়া, ইয়েমেন যুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের মানবিক বিপর্যয়, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পরও তাদের মধ্যে তেমন কোনো বিকার দেখা যায়নি। সাতদিনের যুদ্ধে ইউক্রেনের ৫ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এ সংখ্যা হয়তো দ্বিগুণ হবে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার গণহত্যার শিকার হয়ে রাখাইন থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ১০লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, রোহিঙ্গা বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম জাতিগত গণহত্যার শিকার। এরপরও বিশ্বসম্প্রদায়ের কোনো বিকার নেই! এখন তারা ভ্লাদিমির পুতিনের পারমানবিক হুমকির সম্মুখীন। এটি একটি আধিপত্যবাদের লড়াই। পূর্ব-পশ্চিম ডিভাইডে অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্থায়ী নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে শুধু ইউক্রেনে শান্তি ও সমঝোতাই যথেষ্ট নয়। বিশ্বব্যবস্থায় ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমূল পরির্বতন প্রয়োজন।

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউক্রেনে রুশ সমরাভিযান
আরও পড়ুন