Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৮ এএম

নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। সরকারি জনবলেরও অবস্থা তাই। বিশেষ করে, সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। সরকারি খাতের শ্রমিকদের অবস্থা সর্বাধিক নাজুক হয়ে পড়েছে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছে। তবুও, জনমনে ধারণা, এমনকি তা প্রকাশও করে অনেকেই যে, সরকারি জনবলের বেতন দ্বিগুণ করায় তারা বর্তমান লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বাজারেও ভালো আছে। এছাড়া, ধনীরা আর বাটপাররা ভালো আছে। বাকী লোকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেকেই খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ধনী, বাটপার বর্তমানে ভালোই আছে। সরকারি জনবলের মধ্যে কর্মকর্তা এবং দুর্নীতিবাজরা ভালো থাকলেও সরকারি জনবলের বাকীদের অবস্থা ভালো নেই। তাদের অবস্থা সাধারণ মানুষের মতোই অত্যন্ত নাজুক। ১৫ লাখ সরকারি জনবলের কর্মচারীই অধিকাংশ। জনপ্রশাসনের ‘স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস-২০২০’ বইয়ের তথ্য মতে, জনপ্রশাসনের মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৪ হাজার ৯১৩টি পদে লোকবল রয়েছে। ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য রয়েছে। ২০১৫ সালের জাতীয় পে-স্কেলে সরকারি জনবলের বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে কথাটি সঠিক। কিন্তু এতে বিশাল ফাঁক-ফোকর রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না। যেমন: নিম্ন পদের বেতন দ্বিগুণ হয়ে মাসে বেড়েছে ভাতাদিসহ ৫-৬ হাজার টাকা। আর কর্মকর্তাদের বেতন দ্বিগুণ হয়ে মাসে বেড়েছে ভাতাদিসহ প্রায় ৪০ হাজার টাকা। প্রমাণ স্বরূপ বলা যায়, উক্ত পে-স্কেলের গ্রেড-১ বা সর্বোচ্চ পদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা থেকে। আর গ্রেড-২০ বা সর্বনিম্ন পদের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা হয়েছে ৪ হাজার ১০০ টাকা থেকে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ পদের মূল বেতন বেড়েছে ৩৮ হাজার টাকা আর সর্বনিম্ন পদের মূল বেতন বেড়েছে ৪ হাজার ১৫০ টাকা। অর্থাৎ কর্মকর্তার বেতন বেড়েছে কর্মচারীর বেতনের দশগুণ বেশি। প্রশ্ন ওঠে, জিনিসপত্রের মূল্য কি সে হিসাবে নেয়া হয়? না, তা হয় না। জিনিসপত্রের মূল্য কর্মকর্তার জন্য যা, কর্মচারীর জন্যও তাই। বিন্দুমাত্র তারতম্য হয় না। উপরন্তু জাতীয় পে-স্কেল, ২০১৫-তে টাইম স্কেল সিস্টেম বাতিল করা হয়েছে, যা পূর্বে ছিল কর্মচারীদের জন্য। সরকারি জনবলের মধ্যে কর্মকর্তারা পদোন্নতি, একাধিক গাড়ি ও সার্ভেন্ট, যেনতেন কাজে ঘনঘন দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ ও সফরসহ নানা সুবিধা পায়। কর্মচারীরা এসব সুবিধা পায় না। টাইম স্কেল পেয়ে সে ক্ষতির অনেকটা পুষিয়ে যেত তাদের। পদোন্নতি না পেলেও স্কেল পেয়ে লাভবান হতো। (সর্বোচ্চ তিনটি তথা চাকরির ৮ বছর পূর্তিতে প্রথমটি, ১২ বছর পূর্তিতে দ্বিতীয়টি ও ১৫ বছর পূর্তিতে তৃতীয়টি পেত কর্মচারীরা। উপরন্তু টাইপিস্ট ও স্টেনোগ্রাফাররা স্পিড টেস্টে উত্তীর্ণ হলে ২টি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট পেত। অবশ্য, কর্মকর্তারাও ৪ বছর পূর্তিতে সিলেকশন গ্রেড পেত।) কিন্তু বর্তমান পে-স্কেলে সেসব সুবিধার একটিও নেই। ফলে বেতন দ্বিগুণ হয়ে একদিকে যেমন লাভ হয়েছে, অন্যদিকে, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড ও টেকনিক্যাল ইনক্রিমেন্ট বাতিল হয়ে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে সবাই। সরকারি চাকরিজীবীরা আগে অবসরে যাওয়ার পর শতভাগ পেনশন বিক্রি করতে পারতো। কিন্তু দুই তিন বছর হলো পেনশনের অর্ধেকের বেশি বিক্রি করা যায় না। ফলে তারা স্থায়ী কিছু করতে পারছে না। সর্বোপরি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বহু কর্মচারী রয়েছে অস্থায়ীভাবে ও ঠিকা বেতনে। দীর্ঘদিনেও তাদের চাকরি স্থায়ী হয় না। ফলে তারা পে-স্কেল পায়নি, বেতন বৃদ্ধি হয়নি এবং অবসরের কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। কিন্তু মানুষ এসব দেখে না। দেখে শুধু বেতন দ্বিগুণ হয়েছে! তবে এসব ক্ষতির কারণে বর্তমানের দুর্মূল্যের বাজারে সরকারি জনবলের অধিকাংশই চরম কষ্টের মধ্যে নিপতিত হয়েছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও পরিবারের লোকদের চিকিৎসার চরম ব্যাঘাত হচ্ছে। অবশ্য, তাদের চাকরি, মাস শেষে বেতন ও অবসরোত্তর পাওনাদির নিশ্চয়তা আছে। এটাই তাদের সান্ত¦না।

সরকারি খাতের শ্রমিকদের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। একদিকে, মজুরী ব্যয় অনুযায়ী নয়, অন্যদিকে, চাকরিরও নিশ্চয়তা কমে গেছে। কারণ, কখন কোন কল-কারখানা বন্ধ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন: লোকসানের অজুহাতে গত বছর হুট করে সরকারি সব পাটকল বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়া হয়েছে। এর আগে সরকারি ভারী শিল্পের প্রায় সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি শ্রমিকদের মাসিক বেতন খুবই কম। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেতনও অনিয়মিত। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন অহরহ। এ অবস্থায় তাদের বিরাট অংশ করোনাকালে কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। যাদের কর্ম আছে, তাদেরও বেশিরভাগেরই বেতন কমানো হয়েছে অনেক। উপরন্তু চাকরি হারানোর আশংকা তো আছেই। সর্বোপরি চাকরিচ্যুতি বা অবসরে যাওয়ার পর সার্ভিস বেনিফিট পায় না বেশিরভাগ বেসরকারি শ্রমিক। তাই খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের। এর বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে না তারা। কারণ অধিকাংশের নিয়োগপত্র নেই। গত ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত বিলস’র গবেষণা প্রতিবেদন মতে, ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গত বছর সরকার ঘোষিত লকডাউনে পরিবহন, হোটেল- রেস্তোরাঁ এবং দোকান শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮১%। উপরন্তু ঐ সময় ৮৭% শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়েছে।’ এর বাইরে করোনা মহামারির প্রভাবে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে বিদেশ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ প্রবাসী কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছে বলে গত ২৮ জুলাই একনেকের সভা শেষে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। অপরদিকে, গত ১২ জুলাই বিবিসির খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে এখন ৪০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। ভেরিস্ক ম্যাপেলক্রপট নতুন মডার্ন স্লেভারি ইনেডক্স-২০২০ মতে, ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ ৩২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। দেশের জাতীয় নিম্নতম মজুরী কম্বোডিয়ার চেয়ে অনেক কম।

দেশের শ্রমিক-কর্মচারীদের অবস্থা খুবই করুণ। এরূপ করুণ অবস্থা বিশ্বে আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে আইএলও’র রিপোর্ট প্রণিধানযোগ্য। আইএলও’র গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট-২০২০-২১ মতে, ক্রয়ক্ষমতার বিবেচনায় ২০১৯ সালে মাসিক ন্যূনতম মজুরি ছিল- বাংলাদেশের ৪৮ ডলার। আর এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গড় মজুরী ছিল ৩৮১ ডলার। ২০২০ সালে করোনাকালে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। অথচ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি-মিয়ানমারে ৫.৯%, বাংলাদেশে ৫.৮%, পাকিস্তানে ২.২%, নেপালে ৪.৩%, শ্রীলঙ্কায় ৪ ও আফগানিস্তানে ১.৭%। অক্সফামের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে মজুরি অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। বাংলাদেশে বসবাসের জন্য শোভন মজুরি প্রয়োজন ২৫২ মার্কিন ডলারের সমান অর্থ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের একজন শ্রমিক পায় ৫০ ডলার। ভিয়েনাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের আইটিইউসির গ্লোবাল রাইটস ইনডেক্স-২০২১ মতে, শ্রমিকের অধিকার বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।

যা’হোক, দেশে অতীতে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর জাতীয় পে-স্কেল ও মজুরী কমিশন দেওয়ার রীতি রয়েছে। বর্তমান পে-স্কেল ও মজুরী কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে আগেই। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় নতুন জাতীয় পে-স্কেল ও নতুন মজুরী কমিশন প্রদান করা দরকার। ইতোমধ্যে সে দাবিও উঠেছে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে। তারা সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলও পুনঃচালু এবং পে-স্কেলের ২০টি ধাপের স্থলে ১০টি ধাপ করার দাবি জানিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে গত ২০ জানুয়ারি। তাতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের এন্ট্রি লেভেলে নিযুক্ত কর্মকর্তারা শিক্ষানবিস কালে বেতন-ভাতা হিসেবে ন্যূনতম ২৮ হাজার টাকা পাবেন। এ সময় শেষ হলে প্রারম্ভিক মূল বেতনসহ তাদের ন্যূনতম মোট বেতন-ভাতা হবে ৩৯ হাজার টাকা। এছাড়া, ব্যাংকের মেসেঞ্জার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, অফিস সহায়ক অথবা সমজাতীয় পদ বা সর্বনিম্ন যে কোনো পদের কর্মচারীদের ন্যূনতম প্রারম্ভিক বেতন-ভাতাদি হবে ২৪ হাজার টাকা। চুক্তিভিত্তিক বা দৈনিক ভিত্তিতে বা আউট সোর্সিং বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কর্মচারীদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়, সেক্ষেত্রে স্থায়ীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ করতে হবে।

সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে আইএলও’র অভিমত অনুযায়ী, দেশের সরকারি জনবলের সর্বনিম্ন মাসিক বেতন ২৫২ মার্কিন ডলার করে নতুন জাতীয় পে-স্কেল প্রদান করা দরকার। উপরন্তু ভাতাদিরও হার বাড়িয়ে সময়োপযোগী করা প্রয়োজন। সরকারি শ্রমিকদেরও মজুরী একইভাবে বৃদ্ধি করা দরকার। সর্বোপরি অনুরূপভাবে জাতীয় নিম্নতর মজুরী ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তবে, আইএলও’র শোভন মজুরী অনুযায়ী করা সম্ভব না হলে অন্তত বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পে-স্কেল ও মজুরী প্রদান করা দরকার। তা যতদিন না হয়, ততদিন ৫০% হারে মহার্ঘভাতা দেওয়া প্রয়োজন। সরকারি সব শ্রমিক-কর্মচারীর পূর্ণ পেনশন, শতভাগ পেনশন এককালীন বিক্রি পুনঃচালু, ফ্রি সুচিকিৎসা, নিত্যপণ্যের রেশন ও প্রয়োজনীয় কোয়াটারের ব্যবস্থা, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনঃচালু, অস্থায়ীদের চাকরি স্থায়ী ও শূন্য পদের অর্ধেক পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা দরকার। এছাড়া, বন্ধ করা সব সরকারি কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পুনঃচালু করে শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ষাটোর্ধ নাগরিকদের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মি. মুহিতও এ বিষয়ে বলেছিলেন বহুবার। এমনকি এ নিয়ে ২০১৬ সাল থেকে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। আশা করা যায়, এবার তা দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন