পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশুদ্ধতা ও জাতপাত খোয়ানোর পরও ইংরেজি কেন প্রতিপত্তি বিস্তার করে চলছে? ইংরেজি জানা কেন সারা দুনিয়ায়ই স্মার্টনেসের ব্যাপার? বিশ্বের অনেকে বাণিজ্যিক কারণে চীনা ভাষা শিখছেন। আগে কেবল পণ্ডিতরা শিখতেন, এখন শিখছে অনেক সাধারণ মানুষও। জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষা শেখার কারণও এমনই। এসব দেখে একটু-আধটু প্রশ্ন জাগে, শেষ পর্যন্ত বাংলার হাল কী হবে? হতে পারে, এটা দুর্বল ভাবনা। ভাষাকে একঘরে হয়ে যেতে হয় নানা কারণে। সময়-অসময়ে বিভিন্ন ভাষা নেতিয়ে পড়ে। হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস প্রায় একই। অনেকেই মানতে চান না, ভাষার সঙ্গে কর্মসংস্থানসহ কর্মজগতের বিশাল সম্পর্কের কথা। মানুষ ভাষা সৃষ্টি করতে পারে। আবার পারে অপব্যবহারে, খামখেয়ালিতে ভাষার ছারখার করতেও। কোনো ভাষাকে শক্তিধর রাখতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক পদক্ষেপ দরকার। অথচ, বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়ানোর কথাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে অনেকে। শিক্ষিতদের কেউ কেউ তো এ পক্ষেই। শঙ্কার বিষয়টা ভাষার স্বভাব নিয়ে। টিকে থাকা ও সমৃদ্ধির প্রশ্নে সব ভাষার স্বভাবই এক। কোনো ভাষাই শুধু আবেগ, চেতনা আর ভালোবাসার ওপর ভর করে টিকে থাকে না। মূল ভিত্তির অক্ষুণ্নতা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তি চায় সব ভাষাই। নয়তো দুর্বল হতে হতে একসময় পড়ে যায় তলানিতে, ঝুঁকিতে। বিকৃতি আর শক্তিহীনতার কারণে পৃথিবীর একসময়ের শক্তিধর অনেক ভাষা দুর্বল হয়েছে। কিছু হারিয়েই গেছে। বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভাষায় মেসোডোনিয়ায় আজ কজনে কথা বলে? পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মপ্রণেতার অন্যতম যিশুখ্রিস্টের ভাষাও প্রায় বিলুপ্ত। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, বিশ্ববিজয়ী চেঙ্গিস খানের ভাষা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভাষা নিয়ে আমাদের গর্ব অন্তহীন। ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে এ দেশের মতো আন্দোলন দুনিয়ার কোথাও হয়নি। তাই রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই বাংলার কোনো ক্ষতি হবে নাÑ আশাবাদের এমন জিগির তো করবই। এই জিগির বাস্তব করার ফিকিরও থাকতে হবে। বিশ্বের ত্রিশ কোটি লোকের ভাষাটি মোটেই ধনেজনে দুর্বল নয়। যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তার ওপর বাংলার প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা অসীম। কিন্তু শুধু আবেগ, ভালোবাসা, চেতনায় কি ভাষা বা কোনো কিছুর শেষরক্ষা হয়? হয় কি আদেশ-নির্দেশেও?
হুকুমে ভাষা বিকাশ বা নিয়ন্ত্রণ হয় না। অথচ, ভাষা প্রতিষ্ঠায় আমাদের আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। আদালত বলেছে, বাংলায় ‘সাইনবোর্ড’ নিশ্চিত করতে। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে এ মর্মে আদেশ জারি হয়। আদেশে দেশের সব ‘সাইনবোর্ড’, ‘বিলবোর্ড’, ‘ব্যানার’, গাড়ির ‘নম্বরপ্লেট’, সরকারি দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। এ বিষয়ে যথেষ্ট তদারকিতে সরকারি দফতরের ‘সাইনবোর্ড’ বা নামফলকের বেশিরভাগ বাংলায় রূপান্তর হয়েছে। বাংলায় সরবরাহের কারণে যানবাহনের ডিজিটাল ‘নম্বরপ্লেট’ও অনেকটাই বাস্তবায়ন করা গেছে। তবে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইংরেজিতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ ঠেকানো যায়নি। তা আরও বাড়ছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, দোকানপাট, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ ‘সাইনবোর্ড’, ‘বিলবোর্ড’ ইংরেজিতে লেখা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইংরেজির চাহিদা বেশি। ভোক্তা বা সেবাগ্রহীতাদের চাহিদার কারণেই তারা এমনটি করছেন।
প্রয়োজনে না লাগলে কোনো কিছুরই ব্যবহার বাড়ে না। আর ব্যবহার না হলে বাড়ে না প্রেম-ভালোবাসাও। এটা মোটেই চেতনার বিষয় নয়। চাহিদাই মূল বিষয়। ভাষা হিসেবে বাংলা জীবন-জীবিকার সঙ্গে কতটা সম্পর্কিত? ছোট্ট এ প্রশ্নটির জবাব খুঁজলেই মিলবে কেন ইংরেজির মতো চাহিদা তৈরি হচ্ছে না বাংলার? আমরা সেটা তৈরি করতে পারিনি। সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই চাহিদা তৈরি করতে না পারায় মার খাচ্ছে বাংলা। সেখানে হরদম ঢুকে পড়ছে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসি শব্দ। এটা মোটেই প্রেম বা চেতনার ঘাটতির কারণে নয়। বাংলার প্রতি কোনো অশ্রদ্ধার কারণেও নয়। কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লীগ, পার্টি, ফেডারেশন, ফোরাম, ফ্রন্ট, কমিটি, কমিশন, ইলেকশন, সিলেকশন, ভোট, মিটিং ইত্যাদি মানের বাংলা শব্দ আজও প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলন করা যায়নি। সেই চেষ্টাও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নয়। আবেগ-চেতনা থাকলেও বাংলার উপযোগিতা তৈরি করতে না পারার এ কুফল ভুগতেই হচ্ছে আমাদের। বাংলার তুলনায় ইংরেজির এমন কদর বোধহয় ব্রিটিশ আমলেও দেখা যায়নি। প্রয়োজন প্রশ্নে আমরা পড়ে গেছি, খড়াব ইধহমষধ, ঁংব ঊহমষরংয থিওরিতে। রিজিকের তাগিদে আমরা ইংরেজিকে ব্যবহার করি। আর ভালোবাসি বাংলাকে। ঘরসংসারের জন্য উপযুক্ত একজন, ভালোবাসার জন্য আরেকজনÑ এই বাস্তবতায় চলে গেছে বাংলা। মোটকথা, বাংলা আর বাঙালকে একই দশায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই রোগ ও সুযোগেই হয়েছিল বাংলা সাবান, বাংলা কলা, বাংলা কালি, বাংলা মদ, বাংলা টাকা নামকরণ। এমন নামকরণে নিকৃষ্টই করা হয়েছে বাংলাকে।
সাবান, কলা, কালি, মদ, টাকার মধ্যে নিকৃষ্ট বা কমদামিগুলোর আগে কুবুদ্ধি করেই সাঁটানো হয়েছিল বাংলা শব্দটি। কোনো কাঠামোতে না এনে বাংলাকে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করা, জোর করে সর্বস্তরে বাংলা চালুর বাধ্যবাধকতা আরোপ কতটা সঠিক হয়েছে? বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়সহ দর্শন, ইতিহাসের বাংলা বইগুলো কি মানসম্পন্ন? বাংলা বইয়ের মাধ্যমে এসব বিষয় বোঝার চেষ্টা অনেক ক্ষেত্রেই অর্থহীন। ইংরেজিকে পাশ কাটানোর কারণে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ভালো করে বোঝা সম্ভব নয়। উল্টাপাল্টা বোঝার ঘটনাও ঘটছে। বাংলা মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কারণে ইংরেজি শিক্ষা বন্ধের পথে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজি বই পড়তে অনেকের নাকানি-চুবানি ছুটছে। তা-কি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনকারীদের কাম্য ছিল? এ কাজে যাদের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সেই শিক্ষকরাও লেখাজোখায় ইংরেজিসহ বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করছেন। তাছাড়া, বাংলা প্রতিশব্দ সৃষ্টি করতে গিয়ে তারা কখনো কখনো জন্ম দিয়েছেন ভুল প্রতিশব্দের। মূল বাংলা ব্যবহারে ভুলের ছড়াছড়ি তো আছেই। প্রয়োজনের বাইরে আমাদের মানসিক সমস্যাও পিছু ছাড়ছে না। বক্তৃতা, ভাষণ, টিভির টকশোর আলোচনায় পর্যন্ত ইংরেজি-বাংলার উদ্ভট মিশ্র ভাষা বুঝিয়ে দেয় মাতৃভাষা বাংলাকে আমরা কী চোখে দেখি। সমসাময়িক তরুণ প্রজন্ম এর প্রয়োগ করতে গিয়ে লিখিত-মৌখিক দুইভাবেই এমন সব উদ্ভট শব্দ ছড়াচ্ছে, যা বাংলার জন্য রীতিমতো আতঙ্কের। গল্প-কবিতাসহ উপন্যাস, চলচ্চিত্র-নাটকেও তা সংক্রমিত।
সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমগুলো ভাষাকে শক্তিশালী করা ও সঠিকভাবে ব্যবহারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ভাষার শুদ্ধরূপ প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম অভিধানের চেয়েও শক্তিশালী। অনেকের বাড়িতেই এখনো অভিধান নেই। থাকলেও সেটা পড়ে থাকে বইয়ের তাকে বা শো’কেসে অনাদরে। কিন্তু রেডিও, টিভি বা পত্রিকাহীন কোনো ঘরবসতি বাংলাদেশে নেই। অথচ, গণমাধ্যমে বাংলার করুণ দশা। বাংলার প্রমিত বাচনিক রূপটি মোটামুটি হারাতে বসেছে। রূপ নিয়েও মতভেদ। এতে লেখ্য বাংলার অবস্থা নড়বড়ে। বানান নিয়ে অরাজকতা। বাক্য নিয়ে তো রীতিমতো নাশকতা। উচ্চারণে দুরবস্থা। ব্যাকরণের ধোপে টেকে না এমন বাংলা অহরহই চোখে পড়ে। এ নিয়ে কিছু বললে বিরক্ত হন সহকর্মীদের অনেকে। এতে এমন কিছিমের বাংলাওলারা পুলক পান। তৃপ্তির সঙ্গে গর্ব করেন। কোথাও বাধা না পড়ায় বাহবাও পান। ঠিকভাবে দুই লাইন বাংলা লিখতে জানেন না, কিন্তু মস্ত বাক্যবাগীশের দেখা মেলে অহরহ। ভুলভাল শব্দে বড় বড় কথার খই ফোটে। মাঝে মধ্যে ঠাসঠুস ইংরেজিও বের হয়। শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনীতি সববিষয়ে চড়া গলায় কড়া আওয়াজে দিব্যি ভালোই চলছে তাদের। কিন্তু ভাষাটার কী সর্বনাশ হচ্ছে। এক সময় টেলিভিশনে এবং সাইনবোর্ড বা ব্যানারের লেখা থেকে শেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।