পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নির্বাচন নিয়ে টানাপোড়েন অনেক দিনের। ১৯৭০ সালে এ দেশের জনগণ ভোট দিয়ে কাক্সিক্ষত প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু পাকসেনা কর্মকর্তা এবং ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে তৎকালীন শাসক সে নির্বাচনের ফলাফল বাস্তবায়িত করে নাই। প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলন, যার পরিসমাপ্তি ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। জন্ম লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কি ‘নির্বাচনের’ প্রশ্নে শাসকদল গণমানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে দিচ্ছে?
ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে যেয়ে দিন দিন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়েছে বিধায় জনগণের কাক্সিক্ষত প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার কামনা-বাসনা অধরাই থেকে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু জনগণের রায় সেদিন ক্ষমতাসীনরা মেনে নেয়নি। নির্বাচনে জনগণের রায় মেনে না নেয়ার একটা রোগ জাতির কাঁধে চেপে বসেছিল, যা এখনো অব্যাহত থেকে দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন পদ্ধতির কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত। পঁচাত্তরে জাতীয় সংসদে আইন পাশ করে বাকশাল অর্থাৎ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। কিন্তু ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের কারণে বাকশালী নির্বাচনী ব্যবস্থা দেখার সুযোগ জনগণের হয় নাই। তবে জনগণ মনে করে যে, বাকশাল যেহেতু একদলীয় শাসন সেহেতু শাসকদলের ইচ্ছার বাইরে কারো কনটেস্ট করা তো দূরের কথা, প্রার্থী হওয়ার সুযোগও থাকার কথা নয়। এমনি অবস্থায় পর পর দুইবার দেশে সামরিক আইন জারি হয়। জিয়াউর রহমান সংবিধানে সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ণমাত্রায় রূপায়িত না হওয়ার কারণে কেন্দ্র দখলের মাধ্যমেই নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে উঠে এবং এ সংস্কৃতি গড়ে উঠার পিছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে টাকা, লোভনীয় পোস্টিং ও প্রমোশনের নেশায় মত্ত পুলিশ প্রশাসন ও মেরুদন্ডহীন নির্বাচন কমিশন।
দেশে নির্বাচনে ভোটারদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বিধায় ছোট দলগুলির উদ্যোগেই শুরু হয়, ‘আমার ভোট আমি দেবো, যাকে ইচ্ছা তাকে দেবো’ শ্লোগান। এ আন্দোলনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের রূপরেখা প্রণীত হয় এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে দেশের বৃহৎ দুইটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে পৃথক পৃথক সময়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কারণে পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন নগ্নভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ নিতে পারে নাই। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বুঝা গিয়েছিল যে, সেনাসমর্থিত মইনউদ্দিন-ফকরুদ্দিন সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর সকল কলকাঠি নাড়ছে। যেমন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিরোধীদেরই রাস্তাঘাটে অহেতুক পকেটে টাকা পাওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এ টাকার পরিমাণ এতোই নগন্য ছিল যে, সাধারণ একজন মজুর বা খেটে খাওয়া নিম্নবৃত্ত মানুষের পকেটেও থাকা অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশে অপরাধ দমনের জন্য যে সকল কঠিন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তার সবগুলি আইন বাস্তবায়নের জন্য আইন করেই পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে দিনে দিনে বাংলাদেশে ‘পুলিশ’ একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জনসমর্থন যাই থাকুক না কেন, মাঠের দখল থাকছে সরকার সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে, কারণ পুলিশ থাকে সরকারি দলের পক্ষে। নির্বাচন কমিশন আইন করে নির্বাচনী ব্যয় কাগজে-কলমে কমিয়ে দিয়ে একটি ভালো উদ্যোগ প্রদর্শন করলেও অলিখিত টাকা খরচের জোয়ার তো আর থেমে থাকে না। যার বাজেট যত বড় তার নির্বাচনী প্রসার ঘটে তত বেশি। ঐ বাজেটে পুলিশ-প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের জন্যও একটি অংশ সংরক্ষিত রাখতে হয়, নতুবা নির্বাচনের ৪/৫ দিন পূর্ব থেকেই পুলিশী অ্যাকশন কাকে বলে তা প্রার্থী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে থাকে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অভিজ্ঞ সকল প্রার্থীই বিষয়টি জানলেও পুলিশের পরবর্তী অ্যাকশনের ভয়ে মুখ খোলেন অতি সংগোপনে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসীন হয়ে জাতীয় সংসদে ২০১১ সালে প্রণীত ১৪নং আইনের ২১ ধারা বলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের পরিচ্ছেদটি সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত নির্বাচনে যাবে না, এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ২০১৪ সালে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জামাতসহ ২০ দলীয় ঐক্যজোট অংশ গ্রহণ করে। তবে আওয়ামী আমলাতান্ত্রিক ম্যাকানিজেমের কাছে টিকতে পারে নাই। কারণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার বাইরে কোনো প্রার্থী নির্বাচনে জয়লাভ করার সুযোগ নাই। এখনো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের প্রধান নিয়ামক হচ্ছে পুলিশ এবং পুলিশের নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ সিনিয়র ডিঙ্গিয়ে প্রোমোশন ও লোভনীয় পোস্টিং দেয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকে বিধায় তাকে খুশি-রাজি রাখাই হচ্ছে পুলিশ ও প্রশাসনের একমাত্র দায়িত্ব। অতএব, সরকার যা চাইবে তাই হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হতাশায় পর্যবসিত হয়ে বার বার উচ্চারিত হচ্ছে একটি করুণ হতাশার ধ্বনি।
সংবিধানে আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতির প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ দানের কথা থাকলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবারই সরকার একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি সমর্থন করে নাই। যে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে, অনুরূপ সার্চ কমিটি ২০১৮ সালেও করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে বিচার বিভাগ থেকে যাকে নেয়া হয়েছিল তিনিই এবার সার্চ কমিটির প্রধান, যার সম্পর্কে বিরোধীদল তার পারিবারিক ইতিহাস তুলে ধরে সরকারি ঘরনার লোক হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। তবে তিনি আস্থার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন বলে মিডিয়াতে প্রকাশ করলেও বিষয়টি সম্পর্কে জনগণ এখনো অন্ধকারে রয়েছে। সার্চ কমিটির অন্যতম সদস্য প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নমিনেশন প্রার্থী ছিলেন, অন্য একজন নারী কমিশনার, যার স্বামীর সভাপতিত্বে গঠিত কমিটি প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। এমনিভাবে সার্চ কমিটি গঠন পক্ষপাতিত্বের প্রশ্নে গোড়া থেকেই কঠিন আস্থাহীনতায় পড়েছে। ফলে এ কমিটি সার্চ প্রক্রিয়ার জনগণের কতটুকু আস্থা অর্জন করতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনের বিগত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্বাচন কমিশনে যারাই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তারা তাদের মেরুদন্ড সোজা রাখতে পারে নাই। পাবলিক অফিস পরিচালনার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, মেরুদন্ড শক্ত আছে এমন ব্যক্তি, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে যার অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে নির্বাচন কমিশনকে একটি আজ্ঞাবাহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে হয়েছে বারংবার।
নির্বাচন নামক প্রহসনমূলক খেলা খেলতে জনগণের সহস্র কোটি টাকা গচ্চা যায়। নির্বাচন কমিশনের হাতে কার্যকর কোনো ক্ষমতা নাই। ব্যালট পেপার ছাপানো ও প্রার্থী যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যেই নির্বাচন সীমাবদ্ধ নয়। প্রার্থী ও সমর্থকদের নির্ভয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ গ্রহণের স্বাধীনতা ও ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সে নিশ্চয়তা দেয়ার একমাত্র মালিক-মোক্তার হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সরকারের মদদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে সরকারবিরোধী প্রার্থীকে অত্যাচার-নির্যাতন করে একটি অস্বস্থিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকারি প্রর্থীকে জয়ী করার সমস্ত রাস্তা প্রশস্ত করে দেয়। প্রবাদ রয়েছে যে, ‘বাঘে ধরলে এক ঘা, আর পুলিশে ধরলে ১৮ ঘা।’ নির্বাচনে পুলিশ দায়িত্ব নিয়েই সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে উঠে পড়ে লাগে। গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পুলিশ স্বতন্ত্র প্রার্থীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের হেফাজতের মামলায় গ্রেফতার করে নির্বাচন পরিমন্ডলে একটি ত্রাস সৃষ্টি করে। নির্বাচনের দিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের গ্রেফতার করে সরকারি দলের প্রার্থীর জয়লাভের পথ সুগম করে। একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যেহেতু পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রক যেহেতু সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে মোটেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই সার্চ কমিটির প্রস্তাবে যে নির্বাচন কমিশনই গঠন হোক না কেন, একটি নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।