পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
৭০তম অমর একুশে আজ আমরা উদযাপন করছি। আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৫২ সালের এই দিনটিতেই আমাদের ভাষাপ্রেমীরা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। সমসাময়িক ইতিহাসে এটি এক স্বতন্ত্র ঘটনা। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সূচনা-মুহূর্তও এটি। জাতির জন্য গর্বের বিষয় যে, এই দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে গোটা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে। বিশ্বের মানুষ এ দিনে নিজ নিজ মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শপথ নেয়।
এই ঐতিহাসিক দিনে, সৈয়দ মুজতবা আলিকে আমাদের স্মরণ করা উচিত। আমরা সবাই তাঁকে ব্যঙ্গ কবিতার লেখক, রোমান্টিক, ভাষাবিদ, মহান সাহিত্যিক হিসেবে জানি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে খুব কম লোকই তাঁকে চেনেন বা জানেন। সমসাময়িক বাংলা ইতিহাসে মুজতবা আলি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর ত্রিশটি বইয়ের মধ্যে বিশেষ করে দেশে-বিদেশে, চাচাকাহিনী, শবনম, পঞ্চতন্ত্র, ময়ুরকণ্ঠী ইত্যাদি পাঠকের কাছে কীভাবে সমাদৃত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর পাণ্ডিত্য ও চিন্তাশক্তির ধার ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনিতে। পরিতাপের বিষয় আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলনে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা কমই জানা। আমাদের রাষ্ট্রভাষা হতে হবে বাংলা, এই কথা প্রথম যে ক’জন বলেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম সৈয়দ মুজতবা আলি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটিশ ভারত ভাগের আগে ‘মুসলিম ভারত’-এর সাধারণ ভাষা উর্দু করার জন্য কয়েকজন উর্দু পণ্ডিত দাবি করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে লখনউতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের অধিবেশনে বাঙালি মুসলিম নেতারা এই প্রস্তাব খারিজ করে দেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর, এই উর্দুর দাবি ফের তেজি হয়ে ওঠে। করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে প্রস্তাব নেওয়া হয়, পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে উর্দু। স্কুল ও সংবাদ মাধ্যমে একমাত্র উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব বিশেষভাবে গৃহীত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্ররা এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিস-এর সচিব আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা জোরদার আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তানের সরকারি ভাষা তালিকায় বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করা ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতির দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ এ ক্ষেত্রে আগুনে ঘৃতাহুতি দেন। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা হবে উর্দু। পাঁচদিন পর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে জিন্নাহ ফের একই ঘোষণা দেন। উভয় সভাতেই জিন্নাহ বাধাপ্রাপ্ত হন। উভয় সভাতেই উপস্থিত কিছু সংখ্যক যুবক জিন্নাহর এই কথার তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলনের গতি তীব্র করে তোলে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি অনেকেই মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন।
পাকিস্তান আলাদা দেশ হওয়ার পর, সৈয়দ মুজতবা আলি ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা করার জোরালো দাবি উত্থাপন করেন। সভার কিছু লোক তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান। মুজতবা আলি সিলেটের এই সভায় হয়রানির সম্মুখীন হন। এমন কী তাঁকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু মুজতবা আলি নিজের দাবিতে অনড় থাকেন।
কেন মুজতবা আলি নিজের জেলাতেই অপমানিত হলেন? ওই সময় সিলেটর পরিস্থিতি বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ছিল দেশভাগ-গণভোটের কারণে। এ পরিস্থিতিতেও অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। উর্দু বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয় বলে ওই সময় সতর্ক করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্যে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যদি আমাদের লোকজনের ওপর সরকারি ভাষা হিসাবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে কেবল তাদের স্বার্থে আমাদের শোষণ করার হাতিয়ার তুলে দেওয়া হবে। মুজতবা আলি আরো বলেছিলেন, গোটা বিশ্বের লোক নিজেদের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজের মাতৃভাষাকেই সবচেয়ে উপযুক্ত-সুবিধাজনক মাধ্যম বলে বিবেচনা করেন। তিনি উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ইরান ও তুরস্ক বিজয় করলেও আরবরা অ্যারাবিক ভাষা চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। পার্সি বা তুর্কিশ ভাষা মুছে ফেলতে পারেনি আরবরা। মোঘলরাও ভারতে পার্সি ভাষা চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করেছিলেন, ‘যদি উর্দু পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপানো হয়, তা হলে আমাদের লোক একদিন বিদ্রোহ করবেন। পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবেন।’ তাঁর এ ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীতে সত্য হলো, আমরা আন্দোলন করলাম, সংগ্রাম করলাম এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হতে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জন করলাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ কিন্তু বপন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।
সিলেটে ওই ঘটনার পরই হতাশ মুজতবা আলি বাধ্য হয়ে কলকাতায় পাড়ি দেন। সভায় দেয়া তাঁর ভাষণের পুরোটা সাহিত্য সাময়িকী চতুরঙ্গতে তিনি প্রকাশ করেন। এখানেই অপমানের কাহিনির শেষ নয়। সিলেটে যে অপমানের সূচনা হয়েছিল, তা এক বছর পর বগুড়াতে শেষ হয়। ১৯৪৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বগুড়ার এক সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান স্থানীয় আজিজুল হক কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা। তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞা-চিন্তাধারা দেখে তারা তাঁকে এই কলেজের অধ্যক্ষ পদে বসাতে চান।
কলকাতার সাহিত্য জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে রাজি ছিলেন না মুজতবা আলি। কলকাতা ছেড়ে ছোট জেলা বগুড়ায় আস্তানা গাড়ার বিরোধী হলেও উপর্যুপরি চাপে হার মানেন। কয়েকজন শিক্ষক-ছাত্র কলকাতায় গিয়ে তাঁকে রাজি করান।
১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। এই সময়টা ছিল বিস্ফোরণের মুহূর্ত। ভাষা আন্দোলন তখন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। স্থানীয় ছাত্রছাত্রীরা ভাষা আন্দোলন জোরদার করে তুলেছে। কিন্তু মুজতবা আলির ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না। শুরু থেকেই বগুড়ার কিছু লোক তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত্রের সলতে পাকানো শুরু করে। আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে তাঁর এই নিযুক্তি তারা মেনে নেয়নি। অধ্যক্ষ পদে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়। ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্র কলম ধরেছিল এই ম্যাগাজিনে। মুজতবা আলি অধ্যক্ষ পদে আসীন হওয়ার অনেক আগেই ম্যাগাজিনের লেখা বাছাই হয়ে যায়। এর সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু মুজতবা আলিকেই কাঠগড়ায় তোলা হলো। বলা হলো, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য তিনিই ছাত্রদের প্ররোচিত করেছেন। ম্যাগাজিনে অধ্যক্ষের বার্তা হিসাবে মুজতবা আলি যে লেখা লিখেছিলেন, এতেও চক্রান্ত খুঁজে পায় প্রশাসন। পাকিস্তান সরকার এই ম্যাগাজিন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সব কপি বাজেয়াপ্ত করে।
ব্যাচেলর মুজতবা ওই সময় তাঁর বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজার সঙ্গে থাকতেন। তখন অধ্যক্ষের কোনো আলাদা বাসস্থান ওই কলেজে ছিল না। মুর্তাজা ছিলেন তখন বগুড়ার ডেপুটি কমিশনার। চক্রান্তকারীরা কেবল ছোট ভাই মুজতবা আলিকে হয়রানি করে ক্ষান্ত হয়নি, ডেপুটি কমিশনার মুর্তাজার বিরুদ্ধেও আঙুল তোলে। তাঁকেও এতে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। মুজতবা আলি গ্রেফতারি এড়াতে পালিয়ে কলকাতায় চলে যান। কলেজ অধ্যক্ষ পদে যোগ দেওয়ার সাত মাসের মধ্যেই তিনি ফের কলকাতায় যেতে বাধ্য হন। এদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত ঝরে। লাগাতার আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালে সরকার বাংলাকে স্বীকৃতি দান করে। সিলেটে দেয়া তাঁর বিখ্যাত ভাষণটি আল-ইসলাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশের অনুমতি দেন তিনি। পরবর্তীতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ নামে এই ভাষণ বই আকারে প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে এটি পুনঃমুদ্রিত হয়। এটি খুবই একটি মূল্যবান দলিল। দুর্ভাগ্যের কথা, আমাদের বিরাট সংখ্যক মানুষ ভাষা আন্দোলনে মুজতবা আলির অবদান সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ।
প্রকৃতপক্ষে এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে, ১৯৯৯ সালের ১২ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের তরফে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে অমর একুশকে ঘোষণা করার আর্জি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলিরই ভাতিজা সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি। এ উদ্যোগ সফল হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের তরফে পেশ করা এ প্রস্তাব ইউনেস্কো সাধারণ অধিবেশন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছিল।
মুজতবা আলি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় বিদেশ কাটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মন-হৃদয় গভীরভাবে প্রোথিত ছিল বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পরই তিনি ঢাকায় চলে আসেন। শেষ জীবন পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে অতিবাহিত করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মারা যান। ঢাকাতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর লেখনি সবসময়ই আমাদের প্রেরণার উৎস। তাঁর অদম্য-অজেয় জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা আজও আমাদের কাছে আলোকবর্তিকাস্বরূপ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।