Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিম ক্লোনিং প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে

আবু সালেহ মোহাম্মদ সায়েম | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

সিম কার্ড ক্লোনিং করতে পারলে, একই নম্বরের একাধিক সিম কার্ড হবে। ঐ নাম্বারে কোন কল বা ম্যাসেজ আসলে, তা একই সাথে সব সিমেই আসবে। সম্প্রতি সিম কার্ড ক্লোন করে এক শ্রেণির প্রতারক বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সচিব, পুলিশের আইজি, জেলা প্রশাসকদের মোবাইল নম্বর ক্লোন করে, ইতোমধ্যে এ প্রতারকরা প্রতারণা করেছে।

মোবাইল ঝরস (Subscriber Identity Module) কার্ডের অবিকল প্রতিরূপ/নকল তৈরিই হলো সিম ক্লোনিং। অন্যের মোবাইল নম্বরের মতো নম্বর বানিয়ে পরিচিতজনদের ফোন করা বা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির নম্বর কপি করে ফোন করে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায়ের ঘটনা এখন দেশে আর নতুন নয়। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও, এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। প্রতারণা, টার্গেট করে কোনো ব্যক্তির মোবাইল সিমের তথ্য সংগ্রহ বা চুরি, ছিনতাই করে মোবাইল সিম নিয়ে ক্লোন করে প্রতারণা, হুমকি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর ঘটনাও ঘটছে সিম ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে। এছাড়া ক্লোন করা সিম দিয়ে (মোবাইল নম্বর) এসএমএস বা কল-লগ অথেনটিকেশন নির্ভর যে কারো ফেসবুক আইডি, ইন্সট্রাগ্রাম ইত্যাদি হ্যাক করা সম্ভব। মোবাইল ব্যাংকিং থেকে শুরু করে সকল প্রকার অর্থ লেনদেনের একাউন্ট দখলে নিয়ে, লেনদেনের সকল তথ্যসহ টাকা-পয়সা কব্জা করে নেয়াও সম্ভব। অন্যদিকে, মেসেজিং অ্যাপ আইএমও, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো সেবা দখলে নিয়ে নিতে পারে প্রতারকরা।

সম্প্রতি ছবি শেয়ারের অ্যাপ ইন্সটাগ্রামে ত্রুটি ধরা পড়ার পর, কোম্পানি থেকে জানানো হয়েছে- ক্লোন করা সিম দিয়ে ইন্সটাগ্রাম দখল/কব্জা করা যাবে। শুধু ফান করার জন্য হলেতো কোনো কথা ছিল না, প্রতারকরা শুধু হুমকি ধমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সেবা তথা মেসেজিং অ্যাপসেও নজর রাখছে। সুযোগ পেলেই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ব্যক্তির ইমেজ ও সামাজিক অবস্থানও ধ্বংস করছে। এমনটা চলতে থাকলে, এই চক্রটি রাষ্ট্রের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

ভয়ংকর ব্যাপার হলো, আপনার ফিংগার প্রিন্ট যখন কপি হয়ে যায়, তখন আপনার বলতে আর কোনো তথ্যই আপনার থাকবে না। সম্প্রতি, সিম হারিয়ে গেলে বা নতুন (ফোর জি) সিম কার্ড তোলার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দেখানোর পরেও, আপনাকে ফিংগার প্রিন্ট দিতে হয়। প্রায়ই ফিংগার দুই হাতের চার আঙ্গুলের ছাপ মেশিনে দেয়ার পর, ডিভাইসটি বাফারিং হতে থাকে। লোড হতে সময় নেয়। কখনো কখনো মূল ডেটাবেস থেকে ডেটা ফেস করতে ব্যর্থ হয়। কিছু অসাধু দোকানদার, সুন্দর করে বলে দেবে, সার্ভার বিজি মানে এখন আর সম্ভব নয়। এর মানে হলো আপনার ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে নতুন কোন সিম কার্ড নিবন্ধন করে নিল বা আপনার ফিংগার কপি করে, সংরক্ষণ করে রেখে দিল। পরবর্তীতে এই ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে আপনি যা যা সিকিউরেটেড করবেন, সবই হুমকির মুখে।

আপনি যখন দেখবেন, আপনার মোবাইল ফোনটি সম্পূর্ণ সচল থাকার পরও বলছে সিম বন্ধ আছে অথবা এই নম্বরটি ব্যবহার হচ্ছে না। অথবা মোবাইল ফোনটি অচল থাকলেও আপনার সিম নাম্বারে কল করলে রিং বেজে উঠছে। তখনই বুঝতে হবে, আপনার সিমটি ক্লোনিংয়ের শিকার। অকারণে ব্যালেন্স কমে গেলেও আপনার সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। অপরিচিত কোনো নাম্বার থেকে মিসড কল আসলে, কল ব্যাক করবেন না। কারণ ক্লোন করার সময় একবার (কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিকবার) মিসড কল আসতে পারে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সিম কার্ডগুলো COMP128V1 এলগোরিদমে প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়। ডুপ্লিকেট সিম তৈরির জন্য Plain wafer card ব্যবহার হয়। Silver Wafer card এ PIC16F876, EEPROM24C64 চিপসেট থাকে। এ ধরনের চিপসেটের উপযুক্ত অনেক থার্ড পার্টি সফটওয়্যার ক্লোনিং (ফ্রি-ভার্সন) করার জন্য রয়েছে। সফটওয়্যারের নির্দিষ্ট ধাপ পার হবার পর এক্সট্রাক্ট ও লোড অপশনে গেলেই ন্যূনতম একবার হলেও মিসড কল বেজে উঠবে। এমন প্রযুক্তি রয়েছে, যা ব্যবহার করে প্রতারকরা মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সিম ক্লোন করতে পারে। তবে মোবাইল সিমের তিনটা ভার্সন রয়েছে। এরমধ্যে দুটো ভার্সন (ভার্সন ২ ও ৩) এককভাবে সিকিউরড। ভার্সন ১ অপেক্ষাকৃত দুর্বল। সিম ক্লোনিংয়ের যত ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেছে তার সবই ভার্সন ১-এর সিমে। এই সিম কপি করা যায়।

সচেতন থাকলে সিম ক্লোন হলে অল্প সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে তা বোঝা সম্ভব। বোঝার সাথে সাথেই নিকটস্থ পুলিশ স্ট্যাশনে বিষয়টি অবহিত করতে হবে।


সিম ক্লোন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য বিষয়। ক্লোন করা হলে সিমের হুবহু নকল সিম তৈরি হয়ে যায়। ফলে কে আসল মালিক? কে নকল তা শনাক্ত করা মুশকিল হয়ে যায়। আর এই সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা হুমকি-ধমকি দেওয়া, চাঁদাবাজি করা, সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া, আত্মীয়, বন্ধু-স্বজনদের কাছে টাকা ধার চাওয়া, বিখ্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে বড় কোনও কাজ করিয়ে নেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। কোনো ক্লোন সিম দিয়ে অপরাধ করলে ব্যক্তির (আসল মালিক) পক্ষে পার পাওয়া বেশ কঠিন। যারা সিম ক্লোনিংয়ের সঙ্গে জড়িত, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া তাদের চিহ্নিত করা মুশকিল।

যারা সিম নাম্বার দিয়ে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটঅ্যাপ, ইমেইল, ব্যাকিং সাইট লগ-ইন করেছেন, তারা সিম ক্লোনিংয়ের শিকার হলে, মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। এতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চারিত্রিক, মানসিক হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন।

সম্প্রতি, বিভিন্ন সার্ভিস প্রদান করা প্রতিষ্ঠানগুলো টু-ওয়ে-ভেরিফিকেশন সিকিউরিটি সিস্টেম চালু করেছে। আপডেটেড সকল মোবাইল ডিভাইসে এই সিকিউরিটি সিস্টেম সহজেই ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া একজন ব্যক্তির এনআইডি’র অধীনে কতটি সিম রেজিস্ট্রেশন করা আছে, বিশেষ নাম্বারে এসএমএস করে জানা যায়।

সিম ক্লোনিংয়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সাইবার ক্রাইমের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা ও শাস্তি বাস্তবায়ন করা দরকার। এক্ষেত্রে প্রশাসনের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি পেইড/ফ্রি ভার্সন যে সব সফটওয়্যার ব্যবহার করে ক্লোনিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়, সেসব সফটওয়্যার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, ফিল্টারিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ডাউনলোড করতে না পারে। সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে, অপরাধ দমনে কঠোর নজরদারি করতে হবে। সর্বোপরি, প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল তৈরিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে, যাতে করে প্রযুক্তি যুদ্ধে অপরাধীর কাছে, সাধারণ জনগণ জিম্মি না হয়ে যায়।
লেখক: শিক্ষক, আইসিটি বিভাগ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিম ক্লোনিং প্রতিরোধ
আরও পড়ুন