পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সৃষ্ট উত্তেজনার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গতকালের একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বুধবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড় হুজুর সিরাজুল ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত শহরের ভাদুঘরে জামিয়া সিরাজিয়া দারুল উলুম মাদরাসার প্রধান ফটকে দু’টি তালা মেরে দেয় দুর্বৃত্তরা। সেই সঙ্গে পবিত্র কা’বা শরীফের ছবির উপর মূর্তি বসিয়ে বিরাট পোস্টার সাঁটিয়ে দেয়। ভোরে মাদরাসার ছাত্ররা এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। পুরো ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকালও ফের হামলা ও বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। হামলা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর দূরদর্শিতার অভাব, উদাসীনতা এবং অবহেলা হামলার সুযোগ করে দিয়েছে। হামলার আগে স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতা উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার বলেছেন, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ঘটনা প্রতিরোধে প্রশাসনের শৈথিল্য ও উদাসীনতা ছিল। ঘটনার তিন দিন পর স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট ছায়েদুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনার শুরু থেকেই তিনি বলে আসছেন, তেমন কিছুই হয়নি। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল না। পুলিশ ভালোভাবেই ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, সমগ্র ঘটনায় এক ধরনের রহস্য জড়িয়ে আছে। কেন ও কী কারণে এবং ঘটনার মূল উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে, এ বিষয়টি আড়ালে ঠেলে দিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের প্রতিযোগিতা চলছে। একশ্রেণীর গণমাধ্যমের সংবাদে পরোক্ষভাবে এ ধারণাই তুলে ধরা হচ্ছে, যেন ঘটনার জন্য মুসলমানরাই দায়ী।
ঘটনার সূত্রপাত যে মুসলমানদের অতি স্পর্শকাতর অনুভূতির জায়গা কা’বা শরীফের ছবির উপর শিবমূর্তি স্থাপন করাকে কেন্দ্র করে, তা নিয়ে যতটা না আলোচনা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে হিন্দুদের উপর হামলা নিয়ে। একশ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিশীল গোষ্ঠী এবং কিছু গণমাধ্যম এ নিয়ে হায় হায় রব তুলেছে। তারা ঘটনার মূলে না গিয়ে ঘটনার উপরিভাগ নিয়ে বেশি তোলপাড় শুরু করেছে। তারা এটা উপলব্ধি করতে চাইছে না, কা’বা শরীফের ছবির উপর মূর্তি জুড়ে দেয়ার মাধ্যমে যেভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এর নেপথ্যে কী কারণ এবং অভিসন্ধি রয়েছে, তা তুলে ধরা দরকার। তাদের প্রচার-প্রচারণায় পরোক্ষভাবে এটাই পরিদৃষ্ট হয়ে উঠছে, মুসলমানরাই যেন যেচে হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলে পড়েছে। অথচ বাংলাদেশের মুসলমানদের হাজার বছরের ঐতিহ্যই হচ্ছে, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পারস্পরিক সহাবস্থানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা। স্বাধীন হওয়ার পর বড় ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছে, এমন নজির নেই। বরং সংখ্যালঘুদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা এবং তাদের সমান মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানরা কখনোই কুণ্ঠাবোধ করে না। বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হওয়ার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও এর পেছনে যে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল বা জমিজমা দখল সংক্রান্ত বিষয় রয়েছে, তা সকলেরই জানা। আলেম-ওলামাসহ সাধারণ মুসলমানরা কোন কালে এ ধরনের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, এখনও নেই। উল্টো সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়ে সব সময়ই তারা সোচ্চার থেকেছে। অসাম্প্রদায়িক তকমাধারী পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখা যাবে, সেখানে কেবল খাতা-কলমে অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি রয়েছে। বাস্তবে সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানরা বরাবরই নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে। তারা সবসময়ই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। সেখানে হিন্দুদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়া দূরে থাক, মুসলমানদের স্বাভাবিক ধর্মীয় রীতি-নীতি পালনেও চরমভাবে বাধা দেয়া হয়। বাংলাদেশে এমন একটি ঘটনাও আজ পর্যন্ত ঘটেনি। এ কথা অনস্বীকার্য, কিছু লোক নিজ স্বার্থে হীনকাজ করতে দ্বিধা করে না। এমনকি সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপরাজনীতিও করে। এর অর্থ এই নয়, এই কুচক্রী মহলের সাথে সারা দেশের মুসলমানরা রয়েছে। দুঃখের বিষয়, বাস্তব এ চিত্র পাশ কাটিয়ে কুচক্রী মহলের ঘটানো ঘটনাকে অথবা রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিত ঘটনাকে একটি মহল ও গণমাধ্যম এমনভাবে প্রচার করছে যেন বাংলাদেশের সব মুসলমান সংখ্যালঘুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাটিকে একটি ভিন্নরূপ দেয়া হয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে ঢালাওভাবে মুসলমানদের উপর দোষ চাপানোর প্রবণতা এখানে লক্ষণীয়। ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় ঘটনা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আচরণের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে সচেতন মহলের বুঝতে বাকি থাকে না, এর পেছনে কারা জড়িত এবং এতে কি রহস্য ও দুরভিসন্ধি রয়েছে। এর সঙ্গে আলেম-ওলামা ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও ইসলামী সংগঠন-সমিতির উস্কানি বা সম্পৃক্ততা কোনটাই নেই। ঘটনার পূর্বাপর পর্যালোচনা এবং ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। অথচ একশ্রেণীর মিডিয়া তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপপ্রচারণায় মেতে উঠেছে। এটা কি ধরনের সাংবাদিকতা!
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় এবং তার যথাযথ প্রতিকার হওয়া দরকার। এখানে পারস্পরিক দোষারোপ বা রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করে নেপথ্য কারণ উদঘাটন করতে হবে। যেহেতু ইতোমধ্যে প্রশাসন ও পুলিশের গাফিলতি ও উদাসীনতার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তাই যথাযথ তদন্তের জন্য একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা আবশ্যক। প্রশাসনিক বা অন্য কোনো সংস্থার তদন্তের মাধ্যমে গড়পড়তা প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে কোনো ফল লাভ হবে না। ঘটনার মূল কারণ এবং এর নেপথ্যে প্রকৃত অর্থে যারা জড়িত, তাদের সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে হামলার ঘটনা যেমন উপেক্ষার বিষয় নয়, তেমনি ঢালাওভাবে মুসলমানদের ওপর দোষারোপ করার প্রবণতাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের ঘটনা যাতে এখানেই শেষ হয়, এজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।