পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যাত্রা বাতিলের তিনদিন আগে টিকিট ফেরত দেয়ার সুযোগ হরণ করে রেল মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করেছে বলে গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়। বর্তমান সরকারের আমলে গত তিন বছরে রেলের ভাড়া দ্বিগুণ বাড়ানো হলেও কাক্সিক্ষত সেবার মানবৃদ্ধি বা রেলযাত্রীদের নিরাপত্তা জোরদারে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। এমনিতেই বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত। রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেদখল হওয়া থেকে শুরু করে রেল পরিচালনার প্রতিটি স্তরেই অনিয়ম-দুর্নীতির শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। চলতি বছরের শুরুতে হঠাৎ করে রেলের ভাড়া বাড়ানো হলে সারাদেশে রেলযাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। ইতিপূর্বে ২০১২ সালে রেলের সেবার মান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেলের ভাড়া প্রায় শতভাগ বাড়ানো হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ। রেলের সেবার মান বাড়েনি। নানাক্ষেত্রে রেলের নিরাপত্তাহীনতা এবং দুর্নীতি আরো প্রকট হয়েছে। রেলের আধুনিকায়নের জন্য সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয় করলেও এই ব্যয় রেলের আধুনিকায়ন, নিরাপত্তা, সিডিউল ও শৃঙ্খলা বিধান ও সেবার মানোন্নয়নে কতটা কাজে আসছে তা নিয়ে কোন মূল্যায়ন বা কর্তৃপক্ষীয় নজরদারি নেই বললেই চলে। রেলের ইঞ্জিন ও বগি ক্রয় ও জনবল নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম, অস্বচ্ছতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ঘটনা বার বার মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও অবস্থা পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় রেলওয়ে হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব ও সুলভ গণপরিবহন ব্যবস্থা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ নাব্যতা হারিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উপর অধিক অর্থব্যয় ও গুরুত্ব আরোপ করা হলেও রেলওয়ের উন্নয়নে তেমন কিছুই করা হয়নি। উপরন্তু রেলের হাজার হাজার একর জমি নানাভাবে প্রভাবশালী মহল দখল করে নিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রেলপথকে সমৃদ্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি বেপরোয়াভাবে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে মহামূল্যবান কৃষিজমি নষ্ট করে নতুন সড়ক নির্মাণ ও সড়ক পথের উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে একদিকে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অন্যদিকে নতুন-পুরনো বাস-ট্রাক, প্রাইভেট কারসহ মোটর ভেহিকেল আমদানিতে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ এবং নিম্নমানের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার কারণে অস্বাভাবিক বন্যা, পানিবদ্ধতা এবং বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে দেশ। গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, যেখানে ঢাকা শহরের সড়ক অবকাঠামো আড়াই লাখ গাড়ি চলাচলের উপযোগী, সেখানে নানা ধরনের প্রায় ১০ লাখ গাড়ি চলাচল করছে। ঢাকার যানজট এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের এটি অন্যতম কারণ। রেলওয়ের মত গণপরিবহনের আধুনিকায়ন এবং সেবার পরিসর বিস্তৃত করা গেলে সড়ক পরিবহন এতটা নাজুক অবস্থায় পড়তো না। তবে রেলওয়ের আয়তন বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ রেলের প্রতি অধিক আস্থা ও নির্ভরশীল হলে সরকারী-বেসরকারী খাতে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার মোটরযান আমদানির কমিশন বাণিজ্য থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-আমলারা হয়তো অনেকটা বঞ্চিত হতেন। রেলকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও পশ্চাৎপদ রাখার পেছনে সড়ক পরিবহন খাতের মধ্যস্বত্বভোগীদের স্বার্থের সম্পর্ক থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
গত ১লা নভেম্বর জারি করা রেল মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুসারে এখন থেকে রেলের কোন যাত্রা আরম্ভের (৩ দিন) ৭২ ঘণ্টার কম সময়ে কোন টিকিট ফেরত নেয়া হবে না। যাত্রা আরম্ভের ৫ দিন বা তার আগে টিকিট ফেরত দিলে নির্দিষ্ট হারে টাকা কর্তন, ৯৬ ঘণ্টার বেশী আগে ফেরত দিলে টিকিটের ৫০ ভাগ ফেরত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে পরিপত্রে। ঘোষিত এই পরিপত্রের মাধ্যমে টিকিট ফেরত দানের সুযোগ কমিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে মূলত রেলের দুর্নীতিবাজ টিকেট মাস্টার, অ্যাটেনডেন্ট, গার্ড ও সুপারভাইজারসহ কর্মকর্তাদের পকেট ভারী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। একদিকে রেলে কথিত কোটা সিস্টেমের নামে টিকিট কালোবাজারির সুযোগ অবারিত করা হয়েছে অন্যদিকে টিকেট ফেরত দানের সুযোগ রহিত করে বিনা টিকেটে যাত্রী পরিবহন ও স্ট্যান্ডিং যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে টাকা ভাগ-বাটোয়ারার রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে। ভিআইপি ও সরকারী কর্মকর্তাসহ বিশেষ শ্রেণীর জন্য রেলে ৫ ভাগ সিটের কোটা থাকলেও কোথাও কোথাও দুর্নীতিবাজ রেল কর্মকর্তারা ৫০ ভাগের বেশী কোটা হাতে রেখে অবৈধ টিকিট বাণিজ্য চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ আছে। রেলের আধুনিকায়ন, সেবা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে রেলওয়েকে জনবান্ধব গণপরিবহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রেলের উন্নয়নে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে ইতিমধ্যে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। ভারত ও মালয়েশিয়া থেকে নতুন লোকোমোটিভ এবং কোচ ক্রয়, ডেমু ট্রেন চালু, রেলের ই-টিকিটিং ইত্যাদি পরিবর্তন সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও আশান্বিত করেছে। পাশাপাশি রেলের দক্ষ জনবলের সংকট, নতুন জনবল নিয়োগের নামে নিয়োগ বাণিজ্য, আন্তঃনগর ট্রেনের ভেতর যাত্রীদের হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতার ঘটনায় হতাশ ও উদ্বিগ্ন হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষত রেল বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কোন পদক্ষেপই দেখা যায়নি। এখন নতুন পরিপত্র জারি করে রেলের টিকিট ফেরত দানের সুযোগ রহিত করে প্রকারান্তরে রেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও আস্থা নষ্ট করার তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এ সব অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ও দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থা রহিত করে রেলব্যবস্থাকে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব করে তোলা জরুরি বলে আমরা মনে করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।