Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শায়খুল হাদিস আল্লামা হবিবুর রহমানের ইন্তেকাল!

বালাগঞ্জ (সিলেট) থেকে স্টাফ রিপোটার | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৯:০৪ পিএম

আরব আমিরাতের সাবেক বিচারপতি সিলেটের শায়খুল হাদিস আল্লামা হবিবুর রহমান ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লা ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। গতকাল সোমবার (০৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা ৬ টায় তার নিজ বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিনি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার মাওলানা মুমতায আলী (রাহ.)'র পুত্র। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

মরহুমের জানাযার নামাজ মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৩টায় তার নিজ গ্রাম রারাইসম্পন্ন হবে।

তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

শায়খুল হাদিস আল্লামা হবিবুর রহমানসি লেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন সর্বসাধারণের কাছে তিনি ‘মুহাদ্দিস ছাহেব’ নামে খ্যাত। তাঁর পিতা এলাকার খ্যাতিমান আলিমে দীন মরহুম মাওলানা মুমতায আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি। মাতা মরহুমা আমিনা খাতুন। সাত ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।

শিক্ষাজিবনঃ স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে বাল্য বয়সেই তিনি বড়ভাই মরহুম মাওলানা নজিবুর রাহমান রাহিমাহল্লাহ’র সাথে বর্তমান ভারতের বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন লেখাপড়া করে ফিরে এসে কানাইঘাট থানাধীন সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। সড়কের বাজার মাদরাসায় ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষকগণের উৎসাহে পার্শ্ববর্তী প্রাইমারি স্কুল থেকে জেলা-ভিত্তিক প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে বৃত্তিপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে সিলেটের অন্যতম প্রাচীন ইসলামি বিদ্যাপীঠ গাছবাড়ি জামেউল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের অধীন আলিম পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। একই মাদরাসা থেকে ১৯৫৭ সালে ফাযজিল পরীক্ষায় বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৯ সালে হাদীস বিভাগে কামিল পরীক্ষায় বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য যে, গাছবাড়ি মাদরাসার ইতিহাসে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান লাভকারী প্রথম ছাত্র তিনি।

কর্মজীবন
১৯৫৯ সালের তিন আগস্ট ইছামতি দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় সহকারী মাওলানা পদে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালের দশ এপ্রিল সিলেটের প্রাচীনতম ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদরাসায় যোগ দেন। স্বীয় পীর ও মুরশিদ হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে ১৯৬৩ সালের তেইশ নভেম্বর সৎপুর দারুল হাদীস মাদরাসায় প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালের চৌদ্দ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। পনেরো জানুয়ারি ইছামতি দারুল উলুম মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ইতোমধ্যে সৎপুর দারুল হাদীস মাদরাসার অধ্যক্ষ নিয়ে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা নিরসন কল্পে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের অনুরোধে ১৯৭৬ সালের এগারো অক্টোবর সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে অল্প দিনের মধ্যে মাদরাসার স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ১৯৭৭ সালের দুই এপ্রিল সেখান থেকে চলে আসেন।

আরব আমিরাতে
১৯৭৭ সালে সৎপুর মাদরাসা থেকে চলে আসার কিছুদিন পর তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গমন করেন। প্রথমে উম্মুল কুওয়াইন শহরে একটি মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অল্প দিনের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সে দেশের বিচার বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি উম্মুল কুওয়াইন কোর্টে বিচারক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পাশাপাশি পূর্বোল্লোখিত মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, আরব আমিরাতের কর্মজীবনে সরকারি ছুটির দিনে তিনি মরুচারী বেদুঈনদের অবৈতনিক শিক্ষাদান করতেন। বিশেষ করে বয়স্ক বেদুঈনদের কুরআন শরিফ সহিহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখাতেন।
১৯৮২ সালের চৌদ্দ সেপ্টেম্বর আবারও তিনি ইছামতি মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর নিয়মতান্ত্রিকভাবে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ফলে তিলে তিলে ইছামতি মাদরাসা পূর্ব সিলেটের শ্রেষ্ঠতম ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তাঁর একক প্রচেষ্টায় মাদরাসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়। আলিম, ফাজিল ও কামিল ক্লাশের সরকারি মঞ্জুরি এবং স্বীকৃতি আদায়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। মাদরাসার বিল্ডিং এবং সুবিশাল মসজিদ তাঁর নীরব সাধনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বর্তমানেও তিনি ইছামতি মাদরাসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে ইলমে হাদীসের খিদমতে নিয়োজিত এ মনীষী অধ্যাপনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে কুরআন-হাদীসের শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মাহফিলে বয়ান পেশ করে আসছেন।
এছাড়া তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন।
শিক্ষকতা ও দাওয়াতি কার্যক্রমের পাশাপাশি একসময় তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীতে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির সিলেটের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নেজামে ইসলামের মনোনয়নে তিনি তখনকার সিলেট ৭ আসনে ( জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাট) এমএনএ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সম্মানজনক ভোট পান। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল-ইসলাহ’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আঞ্জুমানে আল-ইসলাহ মনোনীত ও সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় নির্বাচনে সিলেট পাঁচ আসনে (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
তিনি একজন সুলেখকও ছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর লেখা ১৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি শামছুল উলামা আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রাহ.)'র সুযোগ্য খলিফা ছিলেন।



 

Show all comments
  • Ohi A Chowdhury ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ এএম says : 0
    ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার মৃত্যুতে জাতি হারালো হাদিস সাহিত্যের আরেক নক্ষত্র। তিনি সবার কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন, তার সকল খেদমত কবুল করুন এবং বেহেশতে উচ্চ মর্যাদা দান করুন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইন্তেকাল


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ