পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ থেকে ৯৬ বছর পূর্বে ১৯১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার লস্করপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন। তাঁর পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে সৈয়দ আব্দুল মুতাক্কাবির হাসান ও সৈয়দা সালমা খাতুন। তাঁর পিতা ছিলেন হযরত শাহজালাল (রহ.) এর ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সঙ্গী হযরত সৈয়দ নাসির উদ্দিনের বংশের এবং মাতা হযরত শাহজালালের অনুসারী তাজুদ্দিন কোরেশীর বংশধর। জন্মসূত্রে এ.বি মাহমুদ হোসেন সৈয়দ বংশের। সৈয়দ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো শ্রেষ্ঠ। তিনি নিশ্চয়ই একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, শ্রেষ্ঠ পেশাজীবী, শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ছিলেন। যে সমস্ত মানবিক গুণে গুণান্বিত হয়ে একজন মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন সৈয়দ মাহমুদের মধ্যে সে সব গুণ বর্তমান ছিল।
সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন নিজ এলাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করার পর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এম.সি কলেজ হতে কৃতিত্বের সাথে আইএ এবং বিএ পাশ করেন। ১৯৩৬ সালের ২০ ডিসেম্বর শাহ আহসান উল্লাহর পুত্র শাহ আব্দুল আযীয-এর কন্যা সুফিয়া বেগমকে তিনি বিয়ে করেন। উল্লেখ্য মাহমুদ হোসেনের পিতা আবুল হাসান-এর সঙ্গে শাহ আহসান উল্লাহর গভীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এ সম্পর্ককে আরো গভীর ও স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে হাসান সাহেবের ছেলের সঙ্গে শাহ আহসান উল্লাহর নিজ নাতনিকে বিয়ে দেন। এ বিয়ে তার উদ্যোগে সম্পন্ন হয়। এ বিয়ের পর সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ঢাকার শাহ সাহেব লেনস্থ দারুল উলুম আহসানিয়া মাদরাসার অবৈতনিক সুপারিনটেনডেন্ট এর দায়িত্ব পালন করেন।
সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন ১৯৩৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তী বছরে ঢাকা জজ কোর্টে ওকালতি শুরু করেন। মাত্র দু’ বছর ঢাকায় ওকালতি ব্যবসা করার পর স্ত্রী সুফিয়া বেগমের পরামর্শে তিনি নিজ মহকুমা শহর হবিগঞ্জে আসেন এবং ওকালতি ব্যবসাতে যোগদান করেন। এ সময় হতে তিনি রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ হতে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি হবিগঞ্জ মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময় একই সাথে তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নিযুক্ত হন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে সমাজ, জাতি ও দেশের উন্নয়নে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের কাউন্সিলর ছিলেন।
সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল তদানীন্তন পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রথম অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং স্বল্পকালের মধ্যে দেওয়ানী বিভাগের মামলা পরিচালনায় খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে এটর্নি নিযুক্ত হন এবং ১৯৫০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ফেডারেল কোর্টে অ্যাডভোকেট জেনারেল হিসেবে তিনি কাজ করেন। ১৯৪৯ সালে এ.বি মাহমুদ হোসেন পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সদস্য (এমসিএ) নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন এবং এ সময়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জনদাবির সমর্থনে সোচ্চার ছিলেন। বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের গণপরিষদে তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাষা আন্দোলনে তিনি ছিলেন সদা জাগ্রত এক আপসহীন সৈনিক। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালিদের চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব আদায়ের সংগ্রামে সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন বৈষম্যের ব্যাপারে এ.বি মাহমুদ হোসেন সর্বদা কথা বলেন এবং এর সমাধানের পথে বিভিন্ন পরামর্শ দান করেন।
জ্ঞানতাপস এ.বি মাহমুদ হোসেন ১৯৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল তারিখে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন এবং ১৯৭২ সালের ১৬ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ লাভ করেন এবং ৮ নভেম্বর শপথ গ্রহণ করেন। সৈয়দ এ.বি মাহমুদ ১৯৭৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন পেশাগত ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে, তার ব্রতে ব্রতী হয়ে বহু আইনজীবী আজ প্রতিষ্ঠিত। একজন দক্ষ ন্যায়বিচারক হিসেবে তিনি যে দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, এ পেশায় নিয়োজিত অনেকে তার পদাংক অনুসরণ করে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিচারপতি সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, নিরহংকারী ও সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় বিশ্বাস তাকে সুফী মতবাদের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি নিজে যেমন ধার্মিক ও পরহেজগার ছিলেন, পুত্র-কন্যাদের তেমনি ধর্মপ্রাণ ও ধর্মানুরাগী করে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ইংরেজী, উর্দু, আরবী ও ফার্সী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে ও লিখতে পারতেন।
এ.বি মাহমুদ হোসেন এর সাথে আমার পরিচয় ঘটে ১৯৭২ সালে লন্ডন বিমান বন্দরে। জেদ্দাগামী বিমানের জন্য আমরা তখন লন্ডন বিমান বন্দরের কনকর্স হলে অপেক্ষমান ছিলাম। এরপর হতে তাঁর সঙ্গে আমার আসা-যাওয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বয়সের ব্যবধানে তিনি আমাকে ছেলের মতোই স্নেহ করতেন। আমিও তাকে খুব সমীহ করতাম, শ্রদ্ধা করতাম। তিনি একেবারে বাল্যসুলভ সরলতার সাথে প্রাণ খুলে আমার সাথে কথা বলতেন।
বিচারপতি সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন তার জীবনে যা বিশ্বাস করতেন, তা হাসিল করতেন। তাঁর সাহস ছিল অদমনীয় এবং সিদ্ধান্ত ছিল অনমনীয়। যা সত্য, যা বাস্তব তা তিনি অকপটে বলে গেছেন। অত্যন্ত নির্ভিকচেতা, আপসহীন, ন্যায়পরায়ন পুরুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যে বিকশিত ছিল একটি আদর্শ। মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ সচেতনতা, সহমর্মিতা, ন্যায় বিচার, সৎ দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তার স্বাধীনতা এসব গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন।
সৈয়দ এ.বি মাহমুদ হোসেন একটি নাম, একটি আদর্শ। আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই। ১৯৮২ সালের ২ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর নাম, তিনি রেখে গেছেন তাঁর আদর্শ যা অনুকরণীয়-অনুসরণীয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।