পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৭২ সালের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে ১১৮ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, ৫০ বছর পর ২০২২ সালে যে সংবিধানটি বহাল রয়েছে সেখানেও ঐ ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সেই একই কথা বলা আছে। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন (এখন থেকে সংক্ষেপে বলবো ইসি) গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। ৫০ বছর ধরে দেশবাসী অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেই বাঞ্ছিত আইনটি আর প্রণীত হয়নি। এবার, অর্থাৎ এই জানুয়ারি মাসে যখন ইসি গঠন সম্পর্কে প্রেসিডেন্সিয়াল ডায়ালগ শুরু হয়, তখন সরকারপন্থী বিরোধী দলগুলোও আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন যে, ইসি গঠনের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হোক, সেটি তারাও চান। কিন্তু এখন হাতে সময় খুব কম। ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। তার আগেই ইসি গঠন করতে হবে।
সুতরাং মানুষ ধরেই নিয়েছিল, এ যাত্রায় আর ঐ আইনটি প্রণীত হচ্ছে না। গত ১৭ জানুয়ারি ছিল প্রেসিডেন্সিয়াল ডায়ালগের শেষ দিন। ঐ দিন আওয়ামী লীগের সাথে প্রেসিডেন্টের বৈঠক হলো। বৈঠক শেষে মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপট বদলে গেল। পরদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আইনটির খসড়া ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে এবং মন্ত্রিসভায় সেটি পাসও হয়ে গেছে। এই লেখাটি লিখছি ২২ জানুয়ারি শনিবার। বিলটি সংসদে উত্থাপিত হবে ২৩ জানুয়ারি রবিবার। আইনমন্ত্রী আশা করেন, জাতীয় সংসদের চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাস হবে। যদি কোনো টেকনিক্যাল কারণে সেটি সম্ভব না হয় তাহলে আইনটি অর্ডিন্যান্স আকারে জারি হবে এবং পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে পাশ হবে।
একটা ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদক স্বনামে লিখিত একটি কলামে বলেছেন, আইনটি পাস হওয়ার পর সরকারকে অভিনন্দন জানাবে আওয়ামী লীগ। বলবে, যে আইনটির জন্য দীর্ঘ ৫০ বছর দেশবাসী অপেক্ষা করেছে, দেশবাসীর সেই ৫০ বছরের আকাক্সক্ষা আওয়ামী লীগ পূরণ করলো। হয়তো এজন্য উৎসবও পালন করবে। তবে করোনা বর্তমানে যেভাবে সারাদেশকে গ্রাস করছে তার ফলে হয়তো সেলিব্রেশন তারা নাও করতে পারে। করলেও হয়তো সংকুচিত আকারে করবে।
॥দুই॥
এটি তো গেল চিত্রের এক পিঠ। চিত্রের অপর পিঠ হতে পারে এরকম। বিলটি নিয়ে জনসাধারণের মাঝে কোনো আলোচনার সুযোগ থাকবে না, যেসব বিরোধী দল এতদিন ধরে এই ধরনের একটি আইনের দাবি করে আসছে তাদের সাথে কোনো আলোচনা হবে না, সাংবিধানিক আইন বা নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে কোনো মতবিনিময় হবে না, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কোনো নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা হবে না। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যদি কোনো আলোচনা হয়ও, তাহলে সেটি হবে একপেশে। তবে আলেচনা ঠিকই হবে এবং সেটা হবে কিচেন ক্যাবিনেটে। তারপর সেটি উত্থাপিত হবে জাতীয় সংসদে। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পর বিরোধী দলের আলোচনার সুযোগ কোথায়? বিরোধী দলের তো মাত্র ৭ জন সদস্য। তাদের কণ্ঠ তলিয়ে যাবে অবশিষ্ট পৌনে তিনশত কণ্ঠের সগর্জন আওয়াজে। গণফোরামের দুইজন সদস্য তো ইতোমধ্যেই সরকারি সুরে গান ধরেছেন।
॥তিন॥
গত ১৭ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের সংলাপ কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এদিনই মন্ত্রিসভায় ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার আইন, ২০২২’-এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। এটি সংসদে পাস হওয়ার পর চূড়ান্ত আইনে পরিণত হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন এ আইনে হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে একটি জাতীয় দৈনিককে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এ আইনেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ৬ সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ) গঠন করা হবে। এ কমিটির প্রধান হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। অন্য সদস্য হিসেবে থাকবেন, প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, পিএসসি চেয়ারম্যান মনোনীত একজন পিএসসি সদস্য, অডিটর অ্যান্ড কম্পটোলার জেনারেল মনোনীত একজন এবং প্রেসিডেন্ট মনোনীত দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক। তাদের নিয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সুপারিশ করবে। আইনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশরনাদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৫০ বছর এবং সরকারি-আধাসরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগে কমপক্ষে ২০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
নতুন আইন প্রণয়ন নিয়ে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিকের বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘সার্চ কমিটিতে পদাধিকারবলে পাঁচজনকে রাখার কথা বলা হয়েছে। এই পাঁচজনই সরকারের নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তি। তাদের দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করলে সরকারের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটবে। এর বাইরে প্রেসিডেন্ট আরও দু’জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করবেন বলে বলা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাহী বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী দু’জনের নামও প্রেসিডেন্টকে গ্রহণ করতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ প্রেসিডেন্টকে সংবিধান দেয়নি। প্রেসিডেন্ট নিজের ক্ষমতাবলে এই নাম দিতে পারেন না। তিনি বলেছেন, সব মিলিয়ে পুরো সার্চ কমিটি সরকারের পছন্দে গঠিত হচ্ছে। এই সার্চ কমিটি করে যা পাওয়া যাবে, তা সহজেই অনুমেয়।’
আইনটির খসড়া যতটুকু সংবাদপত্রে এসেছে সেটি পড়ে এবং এখন অনেকেই বলছেন, মানুষ একটি নির্বাচন কমিশন আইন চেয়েছে, সার্চ কমিটি আইন নয়। কিন্তু খসড়াটি পড়ে পরিষ্কার বোঝা গেল, ইলেকশন কমিশন আইনের ছদ্মাবরণে এটি একটি সার্চ কমিটি গঠন আইন। আইন করে সার্চ কমিটি গঠনের দরকার কী? বর্তমান হুদা কমিশন এবং তার পূর্বসূরী রকিব কমিশন তো এই সার্চ কমিটিরই ব্রেন চাইল্ড। আর ঐ দুই ‘চাইল্ড’ (নাকি চিলড্রেন?) তো পয়দা হয়েছিল সদ্য অবসর প্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হাসানের ‘ব্রেন’ থেকে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ৫০ বছর পর ‘পর্বতের মুষিক প্রসব’ হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিলটির যে সমালোচনা হচ্ছে সেগুলো পড়ে মনে হচ্ছে, কর্তাব্যক্তিরা আমাদেরকে ‘নাকের বদলে নরুন’ দিচ্ছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ থেকে বলা হচ্ছে ‘নতুন বোতলে পুরাতন মদ’। আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘যার নাম লাউ, তার নামই কদু’।
সার্চ কমিটি যাদের নাম সিইসি এবং ইসির সদস্য হিসেবে প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করবেন, তাদের নাম ধাম এবং ব্যাকগ্রাউন্ড কি জনগণ জানতে পারবেন? অতীতে কিন্তু এগুলি গোপনেই করা হয়েছে। কোন মাপকাঠিতে হুদা এবং রকিবকে বিচারপতি মাহমুদ হোসেন যোগ্য মনে করেছিলেন, সেটি মানুষ আজও জানে না। বেলা শেষে দেখা গেল, তাদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা ছিল কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন গাওয়া।
॥চার॥
ধরা যাক, সার্চ কমিটি প্রেসিডেন্টের কাছে কায়েকটি ভালো ভালো নাম প্রস্তাব করল। সেই নামগুলি থেকেই কি প্রেসিডেন্ট ফাইনালি সিইসি এবং ইসির সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন? অবশ্যই রাখেন না। কারণ, সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) উপ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া ছাড়া আর সমস্ত কাজ তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুয়ায়ী করবেন। সুতরাং সার্চ কমিটি যেসব নাম প্রেসিডেন্টকে দেবেন, সেই সব নাম নিয়ে প্রেসিডেন্ট সাংবিধানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করতে বাধ্য থাকবেন। আর এক্ষেত্রে যাদের সিইসি এবং ইসি সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী সুপারিশ করবেন তারাই ঐসব পদে নিযুক্ত হবেন। তাহলে চূড়ান্ত পরিণামে প্রধানমন্ত্রীই পরোক্ষভাবে হলেও সিইসি এবং ইসি সদস্যদের নিয়োগ দেবেন।
বিলটি যখন জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে তখন তার ওপর বস্তুনিষ্ঠ, কিন্তু সরব আলোচনার সুযোগ কোথায়? বর্তমান পার্লামেন্টে প্রকৃত বিরোধী দলীয় সদস্য সংখ্যা মাত্র ৭। জাতীয় পার্টি তো ২০১৮ সালের ইলেকশনে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে আসন ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তারা তো এবারও ক্ষমতার অংশীদার হতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবার তাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে এবং বিরোধী দল হিসেবে থাকতে বাধ্য করেছে। এছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচন অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচন। তেমন বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্টের আইনগত বৈধতা নিয়ে বিরোধী দল সব সময় প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে। সেই সংসদ কর্তৃক পাস করা ইলেকশন কমিশন আইনও তাই প্রশ্নবোধক থেকেই যাচ্ছে।
আরও অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন আছে। এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে তার আগের দিন খসড়াটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হওয়ার কথা। তখন আরো কিছু জানা যাবে। কিন্তু একটি বিরাট প্রশ্ন: ৫০ বছরে যা করা হয়নি, সেটি দুই সপ্তাহের মধ্যে সেরে ফেলার এমন তাড়াহুড়ো কেন? সকলের অগোচরে খসড়া করা এবং সেই খসড়ায় মন্ত্রিসভার অনুমোদন দানের এই বিদ্যুৎ গতি কেন? এমনি অনেক প্রশ্ন মানুষের মনে।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।