পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক দুর্ঘটনা এবং যাত্রীদের সাথে বাস চালক ও কন্ডাক্টরদের দুর্ব্যবহার, বেপরোয়া আচরণ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাস চালক ও কন্ডাক্টরদের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়েই সাধারণ যাত্রীদের কর্মক্ষেত্র ও গন্তব্যস্থলে যাতায়াত করতে হচ্ছে। যাত্রীদের সাথে তাদের আচরণ এতটাই বেপরোয়া ও অমানবিক যে, তাদের মারধর এমনকি বাস থেকে ফেলে দেয়ার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার ডেমরা থেকে একটি বাসে গুলিস্তানে যাচ্ছিলেন এক যাত্রী। ভাড়া নিয়ে বাসের চালকের সাথে তার বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতির এক পর্যায়ে কন্ডাক্টর তাকে বাস থেকে ফেলে দেয়। এতে তিনি মারা যান। বাস কন্ডাক্টর ২০ টাকা ভাড়া চাইলে ওই যাত্রী ১৫ টাকা দিতে চান। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতির এক পর্যায়ে ওই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মাত্র ৫ টাকার জন্য যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে মেরে ফেলার ঘটনা কোনোভাবেই সহ্য করার মতো নয়। শুধু বাস থেকে ফেলে দেয়াই নয়, একই দিনে রাজধানীর মগবাজারে দুই বাসের পাল্লাপাল্লির মাঝে পড়ে পিষ্ট হয়ে এক কিশোর প্রাণ হারিয়েছে। গাজীপুরগামী একই প্রতিষ্ঠানের দুই বাস একে অন্যকে পেছনে ফেলতে প্রতিযোগিতায় জড়ায়। এ সময় উক্ত কিশোর বাস দুটির মাঝখানে পড়ে যায়। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে রামপুরায় ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে এক শিক্ষার্থীকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিলে কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এক শিক্ষার্থী আরেক বাসের ঘঁষায় হাত হারায় এবং একই সঙ্গে মাথায় আঘাত লাগায় মৃত্যুবরণ করে। বাসের চালক ও কন্ডাক্টরদের এমন বেপরোয়া ও অমানবিক আচরণ ক্রমাগত চললেও এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের পরিবহন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা নতুন কিছু নয়। সড়ক দুর্ঘটনা মহামারির চেয়েও ভয়ংকর হয়ে বছরের পর বছর ধরে চলছে। সড়কে যাত্রীবাহী যানবাহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া আচরণ, চালকের অদক্ষতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের আধিক্যে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৭২টি। এতে নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৮৮ জন। ২০২০ সালের তুলনায় দুর্ঘটনার হার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এ হিসাব থেকেই বোঝা যায়, সড়ক রীতিমত ‘মৃত্যু সড়কে’ রূপ নিয়েছে। দুর্ঘটনার সব কারণ চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় তা বেড়ে চলেছে। দুর্ঘটনার জন্য যানবাহন যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী চালক এবং পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিকদের মানসিকতা। তারা দুর্ঘটনার কারণগুলো আমলেই নিচ্ছে না। আইন-কানুনেরও তোয়াক্কা করছে না। তাদের এ আচরণের অন্যতম কারণ বেনিয়াবৃত্তি। যাত্রী সেবা নয়, তাদের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পকেটের অর্থ কেড়ে নিয়ে এবং হত্যা করে হলেও বাণিজ্য করতে হবে, এটাই তাদের পণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের বেপরোয়া মনোভাব এবং দায়িত্বহীন আচরণ প্রতিদিন সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। বিশ্বের আর কোথাও গণপরিবহনে এমন অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি রয়েছে কিনা, জানা নেই। যাত্রীরা গণপরিবহনে উঠে যেমন অনিশ্চয়তায় থাকে, তেমনি এর অভ্যন্তরেও বাস চালক ও কন্ডাক্টরদের অসাদাচরণের শিকার হয়। নানা ছুঁতোয় নির্ধারিত ভাড়ার বদলে বাড়তি ভাড়া আদায় করা। যাত্রীরা প্রতিবাদ করতে গেলেই তারা চড়াও হয়। প্রতিনিয়তই এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। মাঝে মাঝে এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। গত বছর হাফপাসের দাবীতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এ নিয়ে বাস মালিকরা নানা শর্তে মেনে নিলেও সাধারণ যাত্রীদের সাথে প্রতিদিনই চালক ও কন্ডাক্টরদের সাথে বচসা হচ্ছে। কারো কাছে পর্যাপ্ত ভাড়া নাও থাকতে পারে, তাই বলে দুই-চার-পাঁচ টাকার জন্য যাত্রীর সাথে হাতাহাতি কিংবা বাস থেকে ফেলে দিতে হবে, এটা ভাবা যায় না। গণপরিবহনগুলো এখন অনিরাপদ বাহনে পরিণত হয়েছে। যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার তো হচ্ছেই, কে আগে যাবে এ নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পথচারীদের প্রাণও কেড়ে নিচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগের কথা শোনা যায়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদের ট্রেনিংও দেয়া হয়। এক্ষেত্রে শুধু যানবাহন চালানোর ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি যাত্রীদের সাথে ভদ্র আচরণেরও প্রশিক্ষণ দেয়া উচিৎ। যাত্রীদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, পর্যাপ্ত ভাড়া না থাকলে কিভাবে তা সামাল দিতে হবে, চালক ও কন্ডাক্টরদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। গণপরিবহনে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে এক বাসের সাথে আরেক বাসের পাল্লা দেয়ার বিপজ্জনক প্রতিযোগিতার বিষয়টির প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারী থাকতে হবে। আধুনিক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ গণপরিবহন গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা নিতে হবে। আর যাতে যাত্রী ফেলে দিয়ে হত্যা এবং দুই বাসের রেষারেষিতে কারো মৃত্যু না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড। আর যাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড না ঘটে, এজন্য এর সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকেও সচেতন হতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।