পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে’। মন্ত্রী আরো বলেছেন, ‘গত একযুগে আমাদের গড় আয় ম্যাজিকের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে...।’ এক যুগে মাথাপিছু আয় বাড়লেও আম জনগণের জীবনযাত্রার মান কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। মাথাপিছু আয়ের মধ্যে একটা ফাঁকি আছে, যা কারো অজানা নেই।
একজন মাসে আয় করে ১ লাখ টাকা, আর একজন আয় করে মাসে ১০ হাজার টাকা। উভয়ের মাসিক আয় ১,১০,০০০ হাজার টাকা। গড় আয় ৫৫,০০০ হাজার টাকা। এটাই হলো মাথাপিছু আয়ের হিসাব। নানা ফন্দিফিকিরে দেশের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। নানা কৌশলে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে। কয়েকজন পি কে হালদার, সাহেদ, মোতাজজেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুদের সিন্ডিকেট, পাপিয়া-সম্রাটদের গং, এনু-রুপন বা রুবেল-বরকত ভ্রাতৃদ্বয়দের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার দৃষ্টান্ত কারো অজানা নয়। কিন্তু অজানা শুধু কীভাবে আপনি-আমি অজান্তেই দিন দিন ধনী হয়ে উঠছি!
বর্তমানে একজন শ্রমজীবী, কাজের বুয়া, গার্মেন্ট ও কারখানার কর্মী, পরিবহন শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, বেসরকারী বা প্রাইভেট চাকরিজীবী, নন এমপিও শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। দেশের পরিসংখ্যানে অর্থনীতি সচল, কিন্তু মধ্যবিত্তরা অচল। মাথাপিছু আয় বাড়ানোর চেয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম কমালে অচল মানুষ সচল হতে পারে।
বেশিরভাগ প্রাইভেট কোম্পানির বেতন বাড়েনি, অনেকের কাজ নেই। রাজনীতিবিদ ও সরকারি লোকজন ছাড়া কেউ নিশ্চিন্তে নেই। ৯০ ভাগ মানুষ সরকারি সুবিধার বাইরে। এরপরও মাথাপিছু আয় বাড়ে কীভাবে? সূচক বা পরিসংখ্যান যদি তৈরি হয় ‘অ্যাজেন্ডা’ বাস্তবায়নের জন্য, অর্থাৎ, সরকারকে ভালো দেখানো বা গরিবি কম করে দেখানো, পরিসংখ্যান সেখানে গোয়েবলসের মতোই কাজ করে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এসেছে, সমাজে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে। একশ জনের অধিকার তছরুফ করে, দু’/এক জনের শতকোটি টাকার মালিক হবার অসম, নিষ্ঠুর, অমানবিক হিংস্র প্রতিযোগিতা চলছে। এসব মাথাপিছু আয়ের হিসাব সাধারণ জনগণের কাছে অকার্যকর, কষ্টদায়ক। গরীব আর মধ্যবৃত্তরা উপলব্ধি করছে জীবন কত কষ্টের। শতজনের সুখ কেড়ে নিয়ে দু’চার জন তার সুখ একশ গুণ বাড়াতে পারে, কিন্তু তাতে কমে যায় সুখীর সংখ্যা। মধ্যম ও নিম্নবিত্তরা কি খেয়ে পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে খোঁজ নিলে মাথাপিছু আয় নিয়ে আর নাচানাচি থাকবে না। ওষুধ, ডাক্তার, চাল, ডাল, পেয়াজ, সয়াবিন তেল কিনতে গিয়ে গরিব হচ্ছে মানুষ, আর সরকার পরিসংখ্যানের বিভ্রম নিয়ে বিভর। মাথাপিছু যে আয় বেড়েছে তা চোখে দেখা যায় না, তবে মাথার ওপর যে ব্যায় চেপেছে তা কারো অদেখা নয়। মাথাপিছু ব্যায় কত বেড়েছে, মাথাপিছু ঋণ কতো, সেটাও পরিসংখ্যানে আনতে হবে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবের সাথে জনগণের অভাব-অনটনের হিসাবের আকাশ-পাতাল ফারাক। ধনীদের মাথাপিছু আয় যদি আলাদাভাবে প্রকাশ করা হতো তাহলে প্রকৃত চিত্র ধরা পড়তো। টাকার এই রোবোটিক হিসাবের নির্মম সত্য হল, কেউ খেয়ে দেয়ে, উপভোগ করে রেখে যায় তার অদেখা ১৪ পুরুষের জন্য! আর কেউ তার শিশু সন্তানকে খেতে দিতে পারে না।
একটি জরিপ এসেছে, করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ দেশের ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ বা সোয়া ৩ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, একদিকে দেশের এক বড় সংখ্যক মানুষ যখন আরও দরিদ্র হচ্ছে, সেই সময়ে দেশের মানুষের গড় আয় বাড়ছে। তাহলে মাথাপিছু আয় কার বেড়েছে? প্রশ্নটা এখানেই। ইতিপূর্বে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে গেছে। তাহলে কি মাথাপিছু আয়ের সঙ্গে সুখের সম্পর্কটি ব্যাপক গোলমেলে নয়? প্রবৃদ্ধি বাড়লে সুখ বা সন্তোষও বাড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই উল্টো। এদেশে একদিকে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, অন্যদিকে সুখ কমে।
প্রচ- রৌদ্রের মধ্যে টিসিবির গাড়ি আসার আগে শত শত মানুষ যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন বুঝা যায় দেশের মাথাপিছু আয় কার কত টাকা হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির প্রভাবে যারা তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছে, তাদের মাথাপিছু আয় কোথায়?
প্রতিটা জরিপই বলছে, কোভিডের মধ্যে বেকারত্ব, দারিদ্র্য বেড়েছে এবং আয় কমেছে। ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় ২ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিবিএস জরিপ বলছে, করোনায় সারা দেশের মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। বিআইডিএস জরিপ অনুযায়ী, পোশাক, চামড়া, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকেরই মজুরি কমেছে। পিপিআরসি এবং ব্র্যাকের জরিপ বলছে, গত করোনাকালীন সময়ে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। একই সময়ে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের ফলাফল হচ্ছে, মহামারির মধ্যে দেশের ৫০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ৭৬ শতাংশের ওপরে শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এত কিছুর পরও চলতি বছরে মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তার মানে আয়-রোজগার কাদের বাড়ছে, সেটা কিছুটা আন্দাজ করাই যায়।
বর্তমানে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, নেতা, মন্ত্রী আর তাদের যারা চাটুকর এবং দুর্নীতির সাথে যারা জড়িত তাদের আয় সহস্রগুণ বেড়েছে। যারা সরকারি কর্মকর্তা আছেন তাদের বেতন (কারো উপরি আয়) ঠিক চলছে। যেমন আগে সরকারি কর্মকর্তা, যার বেতন ছিলো ৫০/৬০ হাজার টাকা তাদের বেতন কিন্তু কমেনি। কিন্তু যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তাদের বেতন ২০/৩০ হাজার থেকে কমে এখন ১৫/২০ হাজার টাকা হয়ে গেছে। কার আমলে মানব উন্নয়ন সূচক কত বেড়েছে তা সাধারণ মানুষের দেখার বিষয় নয়। কে কত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলো তাও সাধারণের জেনে লাভ নেই। সাধারণ মানুষ সারাদিন খেটে দু’মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে আর নিজের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। এইটুকু নিশ্চয়তা কি তাদের দেয়া যায় না?
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।