পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানগত দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি। ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ঘোষণা জাতিসংঘ থেকে এসেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন ঘটেছে। প্রতি বছরই এ ধরনের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। গত শুক্রবার বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল আউটলুক প্রতিবেদনেও জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওমিক্রনের প্রভাবে ২০২৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি কমবে। তবে এই সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ হবে বিশ্বসেরা। বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও অগ্রগতি ধরে রাখবে। সংস্থাটি পূর্বাভাসে বলেছে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৪ শতাংশ। পরবর্তী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে হবে ৬.৯ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি অর্জনে উন্নত দেশগুলোকেও পেছনে ফেলবে। যদিও সরকার বলছে, বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৭ শতাংশের উপরে জিডিপি অর্জন করেছে। অন্যদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) জাতীয় মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বড় অর্থনীতির দেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বর্তমানে বাংলদেশ অবস্থান করছে ৪২তম স্থানে। পরিসংখ্যানগত এই পূর্বাভাস দেশের জন্য আশা জাগানিয়া। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বাস্তবে এর প্রতিফলন কতটা দৃশ্যমান, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে।
খাতা-কলমে ও পরিসংখ্যানগত উন্নয়ন সবসময় নিরেট সত্য, এ কথা ধরে নেয়া যায় না। এটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো। হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। বর্তমানে যে ধারার উন্নয়ন ঘটছে, ভবিষ্যতে নানা প্রতিকূলতায় তা নাও হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিসংখ্যানগত পূর্বাভাসের হেরফের হতে দেখা গেছে। আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই, তবে পরিসংখ্যান বা সরকারি প্রতিবেদনে যেভাবে তা তুলে ধরা হচ্ছে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বরাবরই প্রশ্ন তুলেছেন। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার যা বলছে, বিভিন্ন সংস্থা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে। এবারের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদেনে জিডিপি’র যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গেও সরকারের দেয়া তথ্যের বেশ ফারাক রয়েছে। সরকার মাথাপিছু আয় ২৪৫৪ মার্কিন ডলার ঘোষণা করলেও তার মথ্যে ফাঁক রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনা দেশের অর্থনীতিতে মন্দাবস্থা সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সংস্থা ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশের ৬ কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। দারিদ্র্যসীমা বেড়ে ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ঠেকেছে। সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। অনেক নিম্নবিত্ত দরিদ্র, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য পরিবার খাবারের পরিমান তিন বেলার জায়গায় দুই বেলায় নিয়ে এসেছে। মূল্যস্ফীতি ৬-এর ঘরের কাছাকাছি। জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাহিদার অর্ধেক কিনে অনেকে কোনোরকমে জীবনযাপন করছে। রাজধানীতে টিকতে না পেরে অসংখ্য পরিবার গ্রামে চলে গেছে এবং যাচ্ছে। সেখানে গিয়েও যে কিছু করতে পারবে, এ নিশ্চয়তা নেই। দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী যেখানে দরিদ্র অবস্থায় রয়েছে, তার সাথে পরিসংখ্যানের তথ্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা অনস্বীকার্য, করোনার মন্দাবস্থার মধ্যেও কিছু মানুষের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এ সময়ে এক কোটি টাকার উপরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, করোনায় কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১০ লাখ বেড়ে ১ লাখ ৩২৯ জন হয়েছে। এর চেয়ে বেশি অংকের আরও যে অনেক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, তা বলা বাহুল্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সিংহভাগ সম্পদ রয়েছে ৫ শতাংশ মানুষের কাছে। তারাই এ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া বিগত ৭ বছরে কয়েক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে এবং এখনও হচ্ছে। ১৬ কোটির বেশি মানুষের মধ্যে মাত্র এক-দুই কোটি মানুষ অত্যন্ত শান-শওকতে জীবনযাপন করছে। তাদের সম্পদের গড় হিসাব জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ে গিয়ে পড়ছে। বিশাল এক শুভংকরের ফাঁক এবং আয় বৈষম্য আকাশ ছোঁয়া হয়েছে। পরিসংখ্যানের উন্নয়নকেই বড় করে দেখা হচ্ছে, যেখানে বাস্তব পরিস্থিতির সাথে খুব কম মিল রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিদেশী কোনো সংস্থার পক্ষে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যে চিত্র তুলে ধরে বিদেশী সংস্থাগুলো তার সাথে সামান্য হেরফের করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এ একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বলতে বোঝায়, সে দশের মানুষের সুষম ও প্রকৃত জীবনমানের উন্নয়ন। তারা তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে সচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারছে কিনা, তাই উন্নয়নের সঠিক মাপকাঠি। আমাদের দেশে বড় বড় মেগাপ্রকল্পের কাজ হচ্ছে। অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পেরও কাজ চলছে। অর্থনীতিবিদরা এসব প্রকল্পকে মনুমেন্টাল বা স্থাপনাগত উন্নয়ন হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, এগুলো সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। এসব প্রকল্প পরিসংখ্যানগত উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখলেও, প্রকৃত উন্নয়নের স্মারক বলা যায় না। প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে আমাদের দেখতে হবে জীবনমান, সুশাসন, আইনের শাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন কতটা হচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে সুষম উন্নয়ন কতটা হচ্ছে। এ বিষয়গুলো আগে নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।