Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘আমরা শুধু শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিলাম’

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসের টুইন পার্কস নর্থ ওয়েস্ট টাওয়ারের বাসিন্দারা ঘুম থেকে উঠে দৈনন্দিন ঘরের কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎই যেন নরক ভেঙে পড়ল তাদের ওপর। ওই ভবনে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছিলেন ওয়েসলি প্যাটারসন (২৮)। বেলা ১১টার দিকে তিনি যখন বাথরুমে গোছলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই দরজা ধাক্কাতে শুরু করলেন তার বান্ধবী। জানালেন, জানালা দিয়ে মাত্রই তিনি পাশের অ্যাপার্টমেন্টে আগুন দেখেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে প্যাটারসনের অ্যাপার্টমেন্টও অন্ধকার করে তুলল ঘন কালো ধোঁয়া। ঘরের অন্য প্রান্তের কাউকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। পরিষ্কার বাতাসের আশায় বান্ধবী আর ভাইকে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের পেছন দিকের জানালার কাছে যান প্যাটারসন। ততক্ষণে জানালাটা প্রচন্ড গরম হয়ে গিয়েছিল, তারপরও ধাক্কাধাক্কি করে সেটা খুলে ফেলেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়, খোলা জানালা দিয়ে গলগল করে ঢুকতে থাকে উত্তপ্ত ধোঁয়া। বাধ্য হয়ে জানালাটা আবার বন্ধ করে দেন প্যাটারসন। তিনি বলেন, “আমরা শুধু শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।” ১৯ তলা ভবনটির প্রায় সবখানেই তখন শ্বাস নেওয়ার মত বাতাসের বড় অভাব। বাবা-মায়েরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আসা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা করছিলেন। ৫৪ বছর বয়সী সাবেক সেনা সদস্য টনি জনসনের বাসায় পুরানো একটি গ্যাস মাস্ক ছিল। কিন্তু এই জরুরি সময়ে তিনি সেটা খুঁজে পাননি। ভবনের তৃতীয় তলায় আরও নয়টি পরিবারের সঙ্গে মামাদৌ ওয়াগুয়ের (৪৭) পরিবারের বসবাস। বাচ্চাদের একজন আগুনের কথা বলতেই তিনি লাফিয়ে উঠে দেখেন, ঘর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে। বাকি ঘরগুলো থেকে পরিবারের সদস্যদের বের করে সামনের ঘরে নিয়ে আসেন ওয়াগুয়ের। কিন্তু আট বছরের মেয়ে নাফিসাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। দ্রæত আবার মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখেন, বিছানার ওপর বসে সে চিৎকার করছে। ওয়াগুয়ের মেয়েকে তুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করেন। হলওয়েতে আবছাভাবে দেখতে পান, ঘন ধোঁয়ার মধ্যে প্রতিবেশীরা সবাই বের হয়ে আসছেন। তার ১৬ বছরের ছেলে হামে ওয়াগুয়ে বলছিল, “ধোঁয়ায় পুরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আমরা সবাই কাশছিলাম।” ভবন থেকে বের হয়ে আসার বেশ কিছুক্ষণ পর মামদৌ ওয়াগুয়ে বুঝতে পারেন, তার ঠোঁট আর নাক পুড়ে গেছে। সম্ভবত মেয়েকে বের করে আনতে গিয়ে এটা হয়েছে। তিনি বললেন, “তখন মেয়েকে বের করে আনা ছাড়া আর কিছুই মাথায় কাজ করছিল না আসলে।” ভবনের আরেক বাসিন্দা ডানা নিকোল ক্যাম্পবেল তখন পাশের পার্কে কাজ করছিলেন। ছেলেমেয়েরা ফোনে জানাল, ভবনের তৃতীয় তলায় তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ধোঁয়া ঢুকছে। ক্যাম্পবেল তাদের দরজায় ভেজা তোয়ালে ঝুলিয়ে দিতে আর দ্রæত ভবন থেকে বের হয়ে আসতে বললেন। তিনি যখন দেখলেন যে ছেলেমেয়েরা একের পর এক জানালা গলে লাফিয়ে নিরাপদে নিচের আবর্জনার স্ত‚পের ওপর পড়ছে, বড় একটা স্বস্তি অনুভব করেছিলেন তিনি। এদিকে ধোঁয়াচ্ছন্ন অ্যাপার্টমেন্টের গরম জানালাটি খুলে প্যাটারসন যখন বাইরে উঁকি দিতে পারলেন, ততক্ষণে দমকল কর্মীদের একটি দল পৌঁছে গেছে। ওপর থেকে প্যাটারসন চিৎকার করে বলছিলেন, “দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন, আমাদের বের করে নিয়ে যান।” কয়েক মিনিট পর, উদ্ধারকারীরা জানালায় পৌঁছে তাকে এবং তার সঙ্গীদের নিরাপদে বাইরে নিয়ে আসে। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দমকল কর্মীরা একটি বিশৃংখল পরিস্থিতি দেখতে পান। দ্বিতীয় তলার একটি জানালা থেকে ধোঁয়া বের হয়ে সরাসরি উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল এবং ভবনের বিভিন্ন দিকে অন্য অনেক উঁচু তলার জানালা থেকেও ধোঁয়া বের হয়ে আসছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন একই সময়ে অনেকগুলো আগুন ধরেছে। আগুন ধরার সময় একটি অ্যালার্মও বেজেছিল। কিন্তু ওরকম প্রায়ই বাজে। তাই ভবনের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই শুরুতে পাত্তা দেননি। ১২ তলার বাসিন্দা দিলেনি রদ্রিগেজ (৩৮) যখন ধোঁয়ার গন্ধ পেলেন, তখন তিনি সংসারের কাজে ব্যস্ত। বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, দমকল বাহিনীর একটি ট্রাক নিচে দাঁড়ানো। একটি মই দেয়াল ঘেঁষে উঠে এসেছে ঠিক তার জানালার নিচে। তিনি দ্রæত তোয়ালে ভিজিয়ে দরজার নিচে গুজলেন, যাতে অ্যাপার্টমেন্টে ধোঁয়া ঢুকতে না পারে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছিল না। ছোট মেয়ে আর ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে তিনি দ্রæত বেরিয়ে এলেন হলওয়েতে। কিন্তু প্রতিবেশীরা আগেই বেরিয়ে এসেছেন, ফলে সিঁড়িতে প্রচÐ ভিড়। নিচের দিকে সিঁড়ির ধাপগুলো ভেজাও ছিল; ভয় হচ্ছিল, হয়ত পড়ে যাবেন। দমকল কর্মীরা হল পথ ও সিঁড়ি পথ ধরে বারবার যাওয়া-আসা করছিলেন। ছয় তলা পর্যন্ত নামার পর পড়ে থাকা একটি দেহকে পাশ কাটান দিলেনি রদ্রিগেজ। সে কথা মনে করে আফসোসের সঙ্গে বলেন, “আমরা কিছুই করতে পারিনি। দমকল কর্মীরা পড়ে থাকা অনেককে সিপিআর (বুকে চাপ দিয়ে এবং মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিয়ে ফুসফুস ও হৃৎপিÐ চালিয়ে রাখার প্রাথমিক চিকিৎসাপদ্ধতি- কার্ডিও-পালমোনারি রিসাসিটেশন) দিচ্ছিলেন। আমি প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিলাম, কারণ খুবই অন্ধকার ছিল।” দমকল বাহিনীর কমিশনার ড্যানিয়েল এ নিগরো বলেন, এয়ার ট্যাংক নিয়ে যেসব দমকল কর্মী ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, ট্যাংক খালি হয়ে যাওয়ার পরেও তারা ভেতরে অবস্থান করেছেন এবং আটকে পড়াদের খোঁজ করেছেন। ভবনের ১৫ তলায় নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমে পরিবারের সবার সঙ্গে বসে কফি খাচ্ছিলেন ক্রিস্টাল দিয়াজ। এর মধ্যে হঠাৎই সব অন্ধকার হয়ে গেল। ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারপাশ। এর মধ্যে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টায় বিপদ বাড়বে ভেবে তোয়ালে ভিজিয়ে দরজায় রাখলেন, পরিষ্কার বাতাসের জন্য খুলে দিলেন জানালা। তারা দেখতে পান, উদ্ধারকারীরা কাপড়ে পেঁচিয়ে কয়েকটি দেহ নামিয়ে নিচ্ছেন। তখনই বুঝতে পারেন, মারা যাচ্ছে লোকজন। শেষ পর্যন্ত সেই আগুন নিভেছে। ধোঁয়াও কেটে গেছে। কিন্তু বিকাল গড়াতেই পরিবারগুলো হঠাৎ উপলব্ধি করে, তারা এখন আশ্রয়হীন। নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারা রদ্রিগেজ বলেন, “সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আমার প্রতিবেশীরা আমার পরিবারের মতই ছিল।” আহতদের অনেককেই কাছের জ্যাকোবি মেডিকেল সেন্টারের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে। মারিয়া গনজালেজ (৪১) জানালেন, তার ভাগ্নে ড্যানিয়েল নবম তলায় ছিল, হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছে, কিন্তু ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওই হাসপাতালের অন্য অংশে আয়েশা দুকুরে (২৮) তার ২০ জন স্বজনের খোঁজ করছিলেন, যারা সবাই গাম্বিয়ার বংশোদ্ভ‚ত। টুইন পার্কস নর্থ ওয়েস্ট টাওয়ারের এই আগুনে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের নয়জন শিশু। আরও ৪৪ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৩ জনের অবস্থা ভালো নায়। রয়টার্স।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আগুন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ