পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একেকজন মানুষ থাকেন, যাদের জীবনযাপনই ক্রমে একটা আদর্শে পরিণত হয়। একেকজন থাকেন যারা এমনভাবে বাঁচেন যে, ব্যক্তিকে অতিক্রম করে তাদের সেই বাঁচা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। এমনই একজন রিয়াজউদ্দিন আহমেদ।
ভাবীকালকে ভরসা করার মতো জীবনাদর্শ রেখে গেছেন। গত ২৫ ডিসেম্বর সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে সমসময়ের অন্যতম বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার এক বক্তৃতায় বলছিলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের প্রধান রাজনৈতিক সংকট হচ্ছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা। এর বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করাই প্রধান কাজ।
বিএফইউজে আয়োজিত সে সভায় প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল সর্বমান্য সাংবাদিক নেতা অগ্রগণ্য স¤পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদের। ওই বীভৎসতার পতনে কতই না উচ্চাকাক্সক্ষা! সভা চলাকালে করোনায় আক্রান্ত রিয়াজ ভাই হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় পরপারের পথে। সভা শেষ, এল তার প্রস্থান-সংবাদ। পাশে কেউ ছিল না। থাকার কথাও নয়। নিঃসঙ্গ মৃত্যুই কি সাংবাদিকদের নিয়তি? ৭৬ বছর বয়সে বুড়ো না হয়েই তরতাজা অমন মানুষটা চলে গেলেন।
তার স্মৃতিটা ধ্রুবকের মতো আসে। উপমহাদেশের জটিল ব্যাধি অগণতান্ত্রিকতার বিরোধিতায় তিনি ছিলেন আগাগোড়াই সোচ্চার। আস্তিন গুটিয়ে চেঁচামেচির প্রতিবাদ নয়, বরং সাংবাদিকতার প্রণালীতে।
তার সর্বশেষ দৈনিক দি ফিনান্সিয়াল হ্যারল্ডে’র ডিক্লারেশন পেতে ঢের উদ্বেগ ব্যয় করতে হয়েছে। সত্য বনাম শব্দ, ব্যক্তি স্বভাব বনাম রাজনৈতিক কর্তব্য ইত্যাকার দ্বন্দ্বে কঠিন অথচ বিবেকী বিকল্প বেছে নেওয়ার দুরূহ শিক্ষা অর্জনও করেছিলেন তিনি।
মধ্যপন্থা তার প্রিয় আচরণ। পবিত্র কুরআন শরিফে সূরা বাকারার আয়াত সংখ্যা ২৮৬। ঠিক মধ্যবর্তী আয়াত ১৪৩-এ মহান আল্লাহ বলছেন, উম্মতে মোহাম্মদী মধ্যপন্থার লোক। চটজলদি মনে হতে পারে, এর অর্থ হচ্ছে সবদিকে থাকা, করণীয় নির্ণয়ে মাঝামাঝি থাকা। গোবেচারা ভদ্রলোকি।কিন্তু মুফাসসিররা ব্যাখ্যায় জানান, এর মানে আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্য বিধান। আল্লাহর নির্দেশাবলি প্রতিপালনে মন-মগজ-কর্মের ভারসাম্য রক্ষা। ইসলামে ফরজের গুরুত্ব বেশি। সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করার কর্তব্যটুকু প্রধান। এর জন্য প্রয়োজন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা ছাড়া কীভাবে ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলা যায়? ওই জায়গায় রিয়াজ ভাই দৃঢ় সংকল্প এবং জীবনভর তা-ই করে গেছেন। তার সুস্থির মূল্যবোধ এবং অন্তগূঢ় আদর্শবাদ আমাদের মুগ্ধ ও প্রাণিত করে।
‘সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন’ বইয়ে রিয়াজ ভাই সাংবাদিকতার আয়নায় স্বৈরশাসনের বীভৎসতা তুলে ধরেছেন। ক্ষণে ক্ষণে গণঅভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের বিজয়ে আশান্বিত। বইটি উৎসর্গ করেছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে। তার বিমর্ষ বয়ান- স্বৈরাচারের থাবায় মুখ থুবড়ে পড়েছে গণতন্ত্র। লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা লাখো শহীদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে স্বাধীনতার উষালগ্নে।
আরেক বরেণ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদের সেই দীর্ঘশ্বাস জীবনের এতটা পথ হাঁটলাম, কিন্তু আলোর দেখা পেলাম না (একালের বয়ান)। এর শরিকানা রিয়াজ ভাইয়েরও। তার আশার জায়গা ছিল প্রেস ক্লাব। প্রায়ই বলতেন, স্বৈরাচারের সমুদ্রে প্রেস ক্লাব গণতন্ত্রের এক দ্বীপ। বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে ভালো স¤পর্ক ছিল। বেগম জিয়ার মিডিয়া উপদেষ্টাও হয়েছিলেন।
১৯৬৮তে পাকিস্তান অবজার্ভারে রিপোর্টার হিসাবে যোগদান, পরের বছর পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী সদস্য হওয়া, অবজার্ভার ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, ৭৩ থেকে ৭৮ পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সাধারণ স¤পাদক, পরে বিএফইউজের মহাসচিব ও সভাপতি। তারপর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি এবং তার সঙ্গে আমার সাধারণ স¤পাদকত্ব। রিয়াজ ভাইয়ের জীবনটা উদ্ভাসিত দেখি সত্তর দশকে। যখন তার সাংবাদিকতা ও শরীরী যৌবনটা পেখম মেলেছে।
আমাদের জীবনে সত্তর দশকটাই দেখেছি সৃষ্টিশীলতা আর মানবিক বিপর্যয়ের দশক। স্বাধীনতা যুদ্ধ ও আন্দোলনের আখ্যান-ব্যাখ্যানে সাংবাদিক সমাজের বীরোচিত ভূমিকা সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতার পর সংবাদপত্র দলন, সাংবাদিক নির্যাতন, জরুরি অবস্থা, বিশেষ ক্ষমতা আইন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, চারটি বাদে সব দৈনিকের বিলুপ্তির বিরুদ্ধে নির্মল সেন, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানী ও রিয়াজউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। কান্না ও ক্রোধের মধ্যে বাকশালে কিভাবে যোগ দিয়েছেন, সেই স্বীকারোক্তি তার গ্রন্থে উল্লেখিত আছে।
সত্তরে রিয়াজ ভাই যেসব জিজ্ঞাসার জবাব পাননি, মৃত্যুকালেও সেসবের উত্তর পাননি। এখনো মনে হয়, রাজনীতির ইতিহাসে গণ-অভ্যুত্থানটা অপেক্ষমাণ রাস্তার ওপারে। তখন ও এখন ফোর্সড সাইলেন্স ছিল যত দুর্বহ, ফোর্সড ইলোকোয়েন্স ছিল তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণাময়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের গঠনতন্ত্রে আমাদের পূর্বসূরিরা জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম শব্দ তিনটি এনেছেন অনেক ভেবেচিন্তেই। এর সংজ্ঞায় সময় ও সমাজ বারবার সঞ্জীবনী সংযোজন করে।
কিন্তু জীবনের সত্য যার যার তার তার। রাষ্ট্র, জনঅধিকার এবং বাংলাদেশে সাংবাদিকতার আমর্মমূল জানা রিয়াজ ভাইয়ের জন্য মুক্তকণ্ঠ অভিবাদন। দুঃসাহসী মনীষায় সত্যের অনুসন্ধান করে গেছেন। কী সমীহ ও সম্ভ্রমযোগ্য করে গেছেন আপন পরিচয়কে। যথাসময়ে রিয়াজ ভাই যোগ্য স্বীকৃতি পেলেন না অথবা সরকারের শোকবাণী। কোনো অদূর ভবিষ্যতে, প্রত্নতত্ত্বের মতো ওপর মাটিতে এসে সম্মানের আলোয় উদ্ভাসিত হবেন, তেমন দুরসঞ্চারী আশা রিয়াজউদ্দিন আহমেদের ছিল না।
পঞ্চাশ দশকের উল্লেখযোগ্য কবি মানস রায় চৌধুরীর পংক্তিমালা হতে পারে এ প্রয়াণলেখের উপসংহার।
‘তুমি এত তাড়াতাড়ি ছবি হয়ে যাবে কখনো ভাবিনি
আকাশ, শৈশব দূরসুরভীর অবক্ষয়ে
ইন্দ্রিয়ের অননোভূতিতে জেগে থাকবে এওতো ভাবিনি
যেন স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে হঠাৎ তোমার ঘুম পাওয়া
এত নিদ্রালস কখনো তোমাকে আমি ভাবতে শিখিনি
এবং এক মিনিট, এক মিনিট তোমার জন্য নীরবতা।
কপাল বেয়ে রক্ত চুয়োয়, শিরদাঁড়ায় বিদ্ধ ত্রিশূল
কত আনব মুহূর্তের সমন্বয়ে একটি মিনিট
তোমার জন্য হেঁটমুণ্ডে দাঁড়িয়ে আছি সভাস্থলে
হৃৎপিণ্ডে ষাটটি পথের (ষাট বছর)। এক মিনিটের নীরবতা।’
লেখক : সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।