পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নানা ধরনের দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা এবং অনৈতিক মুনাফাবাজির শিকার হয়ে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত যেন নিজেই দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ও অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে। হ্জাার হাজার অনুমোদনহীন বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, হাজার হাজার ভুয়া ডাক্তার এবং অনুমোদনহীন অসংখ্য কারখানায় তৈরী ভেজাল ওষুধের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত এখন দেশের কোটি কোটি মানুষ। দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে এ চিত্র বিদ্যমান। মাঝে মধ্যেই হাসপাতালের অনৈতিক মুনাফাবাজি ও ভুয়া ডাক্তারদের ভুলে রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের তরফে এ ধরনের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লঘু শাস্তি প্রদান করা হলেও সার্বিক অবস্থার গুণগত পরিবর্তনের কোন লক্ষণ চোখে পড়ে না। গত কিছুদিনে ঢাকার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় স্বাস্থ্য খাতের নানামাত্রিক বেহাল দশা, দুর্নীতি, ভেজাল ওষুধ, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত ‘ভুয়া ডিগ্রির বড় ডাক্তার’ শীর্ষক খবরে জানা গেল, শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাতেই আড়াই হাজারের বেশী এবং সারাদেশে ২০ হাজারের বেশী ভুয়া ডাক্তারের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল চিকিৎসকদের কর্তৃপক্ষ বিএমডিসি। তবে বেসরকারী হিসেবে ভুয়া ডাক্তারের সংখ্যা আরো কয়েকগুণ বেশী বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করছে। এসব ভুয়া ডাক্তার এবং তাদের ভুল চিকিসার কবলে পড়ে গত ১৫ মাসে ৩৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের কত মানুষ প্রতিদিন ভুল চিকিৎসা এবং ভেজাল ওষুধের শিকার হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব কারো কাছে নেই।
দেশের মূল ধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিনই ভুয়া ডাক্তার ও ভুল চিকিৎসায় মানুষের জীবন সংহারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি নামী-দামী হাসপাতালের কোন কোন পাস করা ডাক্তারকেও অনভিপ্রেত ভূমিকায় দেখা যায়। দেশের মেডিকেল কলেজগুলো থেকে পাস করে দেশে-বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশকিছু সংখ্যক আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও সার্জন যেমন বাংলাদেশে আছে, পাশাপাশি ডাক্তারীর ভুয়া সার্টিফিকেটধারী এবং কোন রকমে এমবিবিএস পাস করে উচ্চতর ডিগ্রীর জাল সার্টিফিকেট নিয়ে ব্যবসা করছে হাজার হাজার ডাক্তার। এসব ভুয়া ডাক্তার ধরতে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে কিছু সংখ্যক ভুয়া ডাক্তারকে ধরে শাস্তি দিলেও তাদের এই অভিযান প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে প্রতিয়মান হয়। অভিযোগ প্রমাণের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত দু’চার মাসের কারাদ- বা দু’এক লাখ টাকা জরিমানা দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করছেন। যে সব হাসপাতাল এসব ডাক্তার নিয়োগ দিচ্ছে এবং যাদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে ডাক্তারির ভুয়া সার্টিফিকেট কেনা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ধরা পড়ার পর অথবা ধরা পড়ার ভয়ে ভ’য়া ডাক্তাররা স্থান পরিবর্তন করেও ব্যবসায় অব্যহত রাখছে। ভুয়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অনেকে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে ব্যবসা করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
খোদ রাজধানী শহরেই যেখানে হাজার হাজার ভুয়া ডাক্তার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেখানে বিভাগীয় ও জেলাশহরগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। গতকাল সিলেটের একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় সন্তান হারানো এক মা বৃহস্পতিবার স্থানীয় একটি বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে আদালতে ১২৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন। ভুল ও অপচিকিৎসার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগিরা যতই সোচ্চার হোন, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যথোপযুক্ত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদফতর ভুয়া ডাক্তার, অননুমোদিত হাসপাতাল-ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি দেশের বৃহত্তম সরকারী হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে রাজধানীর অধিকাংশ বিশেষায়িত হাসপাতালসহ দেশের সব সরকারী হাসপাতালে চলছে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অনৈতিক কমিশন বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য। বাজার মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশী দামে কোটি কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় করার পরও সাধারণ রোগীরা এসব যন্ত্রপাতির সুফল পাচ্ছে না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কিনে বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হলেও রোগীদের বাইরে বেসরকারী ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে গিয়ে টেস্ট করিয়ে আনতে বাধ্য করা হচ্ছে একশ্রেণীর ডাক্তারের কমিশন বাণিজ্যের কারণে। অন্যদিকে গত তিন দশকে ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে এ শিল্পে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জিত হয়নি, দেশ থেকে বছরে শত শত কোটি টাকার ওষুধ উন্নত দেশগুলোতে রফতানী হচ্ছে। এর বিপরীত চিত্র হচ্ছে, দেশের আনাচে কানাচে গজিয়ে উঠেছে শত শত ভেজাল ওষুধের কারখানা। সেই সাথে বিভিন্ন সীমান্ত পথে বিদেশ থেকে আসছে ভেজাল, নিম্নমানের ও অনুমোদনহীন ওষুধ। ভুয়া ডাক্তার ও ভেজাল ওষুধে এভাবেই চলছে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। মানুষের জীবন ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়সৃষ্টিকারী অপকর্মে জড়িত দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।