পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নৈতিকতাবোধ কেন হারিয়ে যাচ্ছে? দেশপ্রেমের কেন ভগ্ন দশা? কেন গড়ে উঠছে না সহনশীল, সহৃদয়, সুখী ও ন্যায্য সমাজ ব্যবস্থা? এসব প্রশ্ন নিয়ে সামনে আগুয়ান হওয়ার সামাজিক শক্তিও ফেরারি হয়ে পড়েছে। কারণ খুঁজতে গেলে সামনে আসে রাজনীতির প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর বের করা, সমস্যাগুলোর শিকড় চিহ্নিত করা, সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি। বছরের পর বছর বা যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভূত সমস্যার পরিণতি ভয়াবহ হয়। তা বুঝলেও না মানার অন্ধত্ব রাজনীতি ও রাজনীতিকদের সামনে কোথায় নেবে বা নিতে পারে, তার কোনো ঠিক নেই। মূলত, গণমানুষের কল্যাণ ও সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের ধারণা থেকেই ‘রাষ্ট্র’ নামক সঙ্ঘের উৎপত্তি। রাষ্ট্রকে সফল ও সার্থক করে তোলার জন্যই রাজনীতির পথচলা। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি কাঠামো, যা কোনো সমাজের গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিগুলোকে সংজ্ঞায়িত করে। রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় প্রাক-প্রাচীন যুগে, যেখানে প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের রাজনীতি, চাণক্যের অর্থশাস্ত্র ও চাণক্যনীতি (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী) এবং কনফুসিয়াসের রচনাগুলোতে। মূলত, রাজনৈতিক চর্চাটা সর্বসাম্প্রতিক নয়, বরং এর শেকড় অনেক গভীরে। আমাদের দেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন , ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই নেতৃত্ব পরিপক্কতা লাভ করেছিল। সেই পরিপক্ক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই স্বাধীনতা আনার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন রাজনীতিবিদরা। তাদের নেতৃত্বেই ৭১-এ একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশ স্বাধীনতা পায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরে রাজনীতির অগ্রভাগে চলে এসেছে ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে অর্থের জোরে রাতারাতি বনে গেছেন রাজনীতিবিদ। ভাগিয়ে নিয়েছেন সরকারের মন্ত্রিত্ব, সংসদ সদস্যসহ রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ। ৮০-এর দশক থেকেই রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা শুরু। তারপর থেকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনীতিতে বণিকদের সংখ্যা কেবল বেড়েছে, এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে বিভিন্ন জরিপে। এমনটাই মনে করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। আমাদের সংসদ হয়ে গেছে এফবিসিসিআইয়ে একটি বর্ধিত অংশ। যেটা কোনোভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, যা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) দেয়া তথ্য মতে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে মহাজোট থেকে নির্বাচিত পেশায় ব্যবসায়ী আছেন ১৭৪ জন (৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ) এবং ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত আছেন ৫ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া ৩ জন পেশায় ব্যবসায়ী। যদিও পরে কিছু আসনে পরিবর্তন হয়েছে। সেখানেও রাজনৈতিকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেখা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর যে হার ১৫% ছিল, তা এখন অতীতের সব রেকর্ড পেছনে ফেলে দিয়েছে। অবশ্য সংসদগুলোর ধারাবাহিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই বাংলাদেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৫৪ সালে এমপিদের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। পরে ধারাবাহিকভাবেই এটি বেড়েছে। স্বাধীনতার দুই বছর পর প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে ১৫% ব্যবসায়ী ছিলেন সংসদে। এর পরবর্তী সরকারের সময় ব্যবসায়ী, সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের মনোনয়ন দিয়ে সংসদ সদস্য করা হয়েছে। মাত্র ৬ বছরে ১৯৭৯ সালে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫%। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের পরও সেই একই ধারা দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে এসে ব্যবসায়ী এমপির হার হয়েছে ৪৮%, পরে ২০০১ সালের সংসদে এ হার হয় ৫১% এবং ২০০৮ সালে মোট এমপির ৬৩ শতাংশই ছিল ব্যবসায়ী। দশম জাতীয় সংসদে অর্থাৎ ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারা এমপি নির্বাচিত হন, তাদের মধ্যে ১৭৭ জন কোনো না কোনো ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন, যা শতকরা হিসেবে ৫৯ শতাংশ।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। সেই মন্ত্রিপরিষদেও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন ব্যবসায়ী। একইভাবে আওয়ামী লীগের চলমান মন্ত্রী পরিষদের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী রয়েছেন। এখন প্রায় ৬১ শতাংশ সংসদ সদস্যই ব্যবসায়ী। এছাড়া বর্তমান ক্ষমতাসীন দলে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেশি। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা পরিষদে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা রয়েছেন। সংগঠনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্যবসায়ী রয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতা হলেও তাদেরকে তৃণমূলের কেউ কেউ চেনে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে সংসদ আর মন্ত্রিপরিষদে ব্যবসায়ীদের দাপটের কাছে কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে রাজনীতিকরা।
ব্যবসায়ীদের কবলে রাজনীতি› না ‘রাজনীতিবিদদের কবলে ব্যবসা’র কোনটাই আসল ব্যাপার নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো ব্যবসা, রাজনীতি, কোনো পেশাই আজ দুর্নীতিবাজমুক্ত নয়। গোটা দেশটাকেই আজ কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর দুর্নীতির শিকারে পরিণত হয়েছে। রাজনীতির ওপর ভর করে বেড়ে উঠছে একটি দুর্বৃত্ত শ্রেণি তাদের কাছে অপরাধ-দুর্নীতি-লুটপাট সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাধারণ মানুষের জীবনমান, নিরাপত্তা, নীতি-নৈতিকতা সেখানে যেন কোনো বিষয়ই নয়। লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাস, বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা, সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অধঃপতন ও শূন্যতা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার অভাব দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসে আছে। এসব শিকড় জন্ম দিচ্ছে নিত্যনতুন নৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপরাধ। এসব অপরাধ ধ্বংস করছে সততা, নীতিনৈতিকতা ও মানবতাবোধ। শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। ছিঁড়ে ফেলছে সামাজিক বুনন।
চাহিদার সীমানা কম বলে মুক্তির কথা গরিবের বেশি পছন্দ। মুক্তি বলতে তারা বোঝে অভাব থেকে মুক্তি। পেট ভরে দুই বেলা খেতে পারাই স্বাধীনতা। মুক্তি ও স্বাধীনতার দৌড় ছোট হওয়ায় তাদেরকে রাজনীতিতে পণ্য বানানো সহজ। অল্পতেই তুষ্ট করা যায়। গড়ের অংকে আয়-আয়ু, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জরিপ শুনিয়ে মাতিয়ে দেয়া যায়। তাই আদাব-সালামে ক্ষমতাবানকে তেলতেলে করে দেয় তারা। নিজেরা নেতৃত্ব চায় না। এমপি-মন্ত্রী হওয়ার কথা ভাবে না। এমপি-মন্ত্রীসহ ক্ষমতাবানদের তল্পিবাহক হয়ে সংখ্যালঘু হয়ে ইহলীলা সাঙ্গ করার নিশ্চয়তা পেলেই যারপরনাই খুশি তারা। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে খবর ও তথ্যের শেষ নেই। দারিদ্র্য কমছে, দরিদ্রও কমছে। গরিব খুঁজে পাওয়া যায় না- এমন কিচ্ছাও শোনানো হয়। এ সংক্রান্ত জরিপ-গবেষণাও প্রচুর। সর্বশেষ এক জরিপে বলা হয়েছে, এক দশকে দেশে অন্তত ১০ হাজার কোটিপতির জন্মেছে। আরেক জরিপ বলছে, এই ১০ হাজারেরই হাজার খানেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকসহ নানা জায়গায় এন্তার অভিযোগ। তাদের উত্তরসুরীও অনেক। স্বার্থ ও শ্রেণি বিবেচনায় তারা সবসময় দলে-বলে শক্তিমান।
স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তির যাবতীয় সুখ-সম্ভোগ লুটে নিয়েছে এই শ্রেণিটিই। দেশের রাজনীতি চলে গেছে পুরোপুরি তাদের দখলে। আর তাই সংসদেও বেশিরভাগ তারাই। ফলে সময়কে কঠিন করে দিয়েছে তারা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা রাজনীতিতে সংঘাত, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়নতা এবং রাজনীতিবিদদের অন্যৈক্যের কারণে ততটা এগিয়েছে কিনা তা নিয়েও রয়েছে নানা মত। আর কেনই বা জনকল্যাণমুখী না হয়ে রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা। ব্যাংকে জনগণের টাকা গচ্ছিত থাকে। সে অর্থ লুট হয়ে যাচ্ছে তথাকথিত ঋণের আবরণে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন শুধু সুশাসনের ব্যত্যয় নয়, দেশের অর্থনীতিকেও বিপজ্জনক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন রাজনীতিকরা গৌরবের সঙ্গে পেশা হিসেবে পরিচয় দিতেন রাজনীতি। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। একসময়কার অনেক পেশাদার রাজনীতিকও এখন আবার সরাসরি বিভিন্নভাবে ব্যবসা করছেন। নামে-বেনামে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তারা ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন-আছেন। মাঠ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একই অবস্থা। এমনকি ডান-বামসহ সব ধরনের নেতাই এখন ঝুঁকছেন ব্যবসার দিকে। দলে দলে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলে যোগ দিচ্ছেন ব্যবসার কারণেই। ছাত্র-যুব সব পর্যায়ের রাজনীতিতেই এখন একই চিত্র। আবার এমপি হওয়ার পরই পাল্টে গেছে কারও কারও পেশা। আগে ব্যবসা না করলেও এমপি হওয়ার পর জড়িয়ে পড়েছেন ব্যবসার সঙ্গে। নামে-বেনামে গড়ে তোলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কোথাও তাদের তেমন বাধায় পড়তে হয় না। থামতেও হয় না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।