Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

রাজধানীসহ দেশের সড়কে নৈরাজ্য কোনোভাবেই থামছে না। যাত্রী পরিবহন ও উঠা-নামার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা নেই। যত্রতত্র অবৈধ গাড়ি পার্কিং থেকে শুরু করে একশ্রেণীর চালকের বেপরোয়া আচরণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে অকালে অনেক মানুষের প্রাণ যাচ্ছে এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। যাত্রাপথ মৃত্যুর পথে পরিণত হয়েছে। ঘর থেকে বের হয়ে কেউ যে আবার ফিরতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সড়ক দুর্ঘটনা এখন এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, তার চিত্র দেখলে আঁৎকে উঠতে হয়। বেসরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ৪ হাজার ৬৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোড অ্যান্ড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু গত ডিসেম্বরেই ৩৮৩টি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৪১৮ জন। এর মধ্যে রয়েছে ৬৬ জন শিক্ষার্থী। এ হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ১২টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ চিত্র দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সড়ক দুর্ঘটনা কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা একে ‘গণবিধ্বংসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নতুন কিছু নয়। বহু আগেই এসব কারণ চিহ্নিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কারণ চিহ্নিত হলেও প্রতিকারের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকারে দিনের পর দিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। সড়ক অবরোধ করে তাদের সহপাঠীদের হত্যার বিচার চেয়েছে। সরকারের তরফ থেকে সড়ক নিরাপদ ও দুর্ঘটনার কারণ প্রতিকারের ব্যবস্থা করা হবে বলা হলেও, তার বাস্তব কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। উল্টো দুর্ঘটনার হার বেড়ে চলেছে। সাধারণভাবে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে, চালকের বেপরোয়া আচরণ, আনফিট যানবাহন, অতিরিক্ত গতি, চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিয়ন্ত্রণ হারানো, মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল, সড়কের অবৈধ দখল, যেখানে সেখানে যানবাহন পার্কিং ও যাত্রী উঠা-নামা করা, অপর্যাপ্ত ট্রাফিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। তবে বেশিরভাগ দুর্ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে, চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও গতি। গত মাসের শেষের দিকে এয়ারপোর্ট রোডে এনা পরিবহনের একটি বাস সড়কের উঁচু ডিভাইডারের উপর দিয়ে পাশের সড়কে একটি মাইক্রোবাসের উপর গিয়ে পড়ে। এতে বোঝা যায়, চালকরা কতটা বেপরোয়া। এর আগে অদক্ষ চালকের কারণে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে চালকের বেপরোয়া আচরণ দায়ী। এ নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি এবং গবেষণা সংস্থা প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো চৈতন্য নেই। মেট্রোরেলসহ নানা উন্নয়ন কাজ চলায় এমনিতেই রাজধানীর সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়েছে। প্রশস্ত সড়ক গলির আকার ধারণ করেছে। এই স্বল্প সড়কের মধ্যে মোড়ে মোড়ে ট্র্যাফিক পুলিশও রয়েছে। এর মধ্যেই চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে এবং দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। ট্র্যাফিক ও সড়ক ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই। এর প্রতিকার না হওয়ায় একের পর এক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। কর্মজীবী যাদের প্রাণ যাচ্ছে, তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। একটি পরিবারের কর্মজীবীর মৃত্যু শুধু সেই পরিবারকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়া নয়, দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে তার যে মেধা ও দক্ষতা, তারও পরিসমাপ্তি ঘটে। অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক হিসেবে দেখানো হয়েছে, গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৪৫৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, সেসব পরিবারের ক্ষতি নিরূপণ করা সহজ কাজ নয়। দুর্ঘটনার জন্য তারা যেমন দায়ীদের দায়ী করতে পারছে না, তেমনি তাদের ক্ষতিপূরণও হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া ও অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাদের গ্রেফতার করা হলেও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না। এক্ষেত্রে পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠে। সরকারও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া থেকে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে যে আইন করা হয়, তা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

দুর্ঘটনা রোধে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা স্থাপন করার বিকল্প নেই। দুর্ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা বা দৈব ঘটনা বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব দায়ী। এ দায় সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারে না। সড়কে ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং দায়িত্বরতরা সচেতন থাকলে যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায়, তার বাস্তব উদাহরণ হয়ে রয়েছে ঢাকার ক্যান্টমেন্ট এলাকা। এ এলাকায় সুশৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং কড়া নজরদারি থাকায় প্রত্যেক যানবাহন ও যাত্রীরা শৃঙ্খলা মানতে বাধ্য হয়। এতে দুর্ঘটনা বা অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। এ থেকে বোঝা যায়, রাজধানীসহ দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত, তারা যদি যথাযথভাবে সড়ক আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কঠোর এবং আন্তরিক হয়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এ ব্যাপারে সচেতন ও কর্মতৎপর হতে হবে। বেপরোয়া চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং সড়কের শৃঙ্খলাবিরোধী অপকর্মের সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেকোনো মূল্যে সড়ক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা ও নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেয়া যাবে না। যাত্রীদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়কে নৈরাজ্য
আরও পড়ুন