Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রাম বন্দরে দারুণ ব্যস্ততা

কন্টেইনার কার্গো জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে রেকর্ড আমদানি-রফতানিতে নতুন গতি

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

দারুণ ব্যস্ততা দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর-শিপিংয়ে। সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার এই বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড, বহির্নোঙ্গরে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য। মালামাল এবং কন্টেইনার ওঠানামা চলছে সার্বক্ষণিক। স্বাভাবিক রফতানি পণ্য জাহাজিকরণ। সচল রয়েছে আমদানি-রফতানি পণ্য ডেলিভারি পরিবহনও। বছর শেষ না হতেই কন্টেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে সকল রেকর্ড চাড়িয়ে গেছে বন্দর। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এই বন্দরের জেটি, বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড, প্রাইভেট ডিপোতে (অফডক) নেই কোন জট। জাহাজ আসলেই কম সময়ে ভিড়ছে জেটিতে। বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেলগুলোও দ্রুত পণ্য খালাস করতে পারছে।
আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় কন্টেইনার ওঠানামা এবং নৌপথ ও সড়কপথে পরিবহন স্বাভাবিক রয়েছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য খাতের রফতানি পণ্য দ্রুত বন্দরে পৌঁছে যাচ্ছে। বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য কম সময়ে ডেলিভারি নিতে পারছেন কনসাইনিরা। চলতি বছরের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার পোর্ট ক্ল্যাংসহ বিভিন্ন মাদার পোর্টে মারাত্মক জট পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে চট্টগ্রাম বন্দরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির ধাক্কা এবং পর্যাপ্ত ফিডার (ছোট) জাহাজ ও খালি কন্টেইনারের ঘাটতি এবং সেইসাথে কন্টেইনার ভাড়া (প্রেইড চার্জ) বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে রফতানি কার্যক্রম হোঁচট খায়। বেসরকারি ডিপোগুলোতে রফতানিমুখী পণ্যবাহি কন্টেইনারের স্তূপ জমে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বন্দরের পক্ষ থেকে নেয়া তাৎক্ষণিক উদ্যোগে সঙ্কট ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে। মাদার পোর্টগুলোর পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে চট্টগ্রাম বন্দরে গতি ফিরে। বন্দরে কন্টেইনার ওঠানামা এবং রফতানি পণ্য জাহাজিকরণ স্বাভাবিক হয়ে আসে। গত কয়েক মাস ধরে বিশেষ করে চলতি ডিসেম্বরে বন্দর কার্যক্রম আরও গতিশীল হয়। বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, জেটি, ইয়ার্ড সম্প্রসারণ, নতুন নতুন ইক্যুইপমেন্ট সংযোজন এবং সেইসাথে দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। করোনার কঠিন সময়েও মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়নি বন্দরের কার্যক্রম। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের এ সক্ষমতার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের আমদানি-রফতানি, উন্নয়ন, বিনিয়োগসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে।
চট্টগ্রাম বন্দর সার্বক্ষণিক সচল থাকায় জ্বালানি তেলসহ ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল দ্রæতসময়ে কারখানায় পৌঁছে যাওয়ায় উৎপাদনের চাকা সচল রয়েছে। সার্বিকভাবে আমদানি-রফতানি বৃদ্ধির পরেও জট পরিস্থিতি না থাকা বন্দরের সক্ষমতারই প্রমাণ বহন করে। বন্দর-শিপিং সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে বার্থিং পাওয়ার জন্য জাহাজগুলোকে এখন বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। বহির্নোঙ্গর থেকে সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারছে কন্টেইনার ও খোলা পণ্যবাহী জাহাজ। বন্দরের প্রতিটি জেটি এবং ইয়ার্ডে সার্বক্ষণিক পণ্য কন্টেইনার ওঠানামা চলছে। রফতানি পণ্য নিয়ে দ্রæত বন্দর ত্যাগ করতে পারছে বিদেশি জাহাজগুলো। মাদার পোর্টগুলোতেও এখন জট পরিস্থিতি নেই। ফলে নির্ধারিত সময়ে রফতানি পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে দেশের ইমেজ বাড়ছে।
নগরীর পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়েওঠা ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে নেই কন্টেইনার জট। রফতানি পণ্যবাহী কন্টেইনার দ্রæত বন্দরে পৌঁছানো হচ্ছে, হচ্ছে জাহাজিকরণ। এবারের বড়দিনকে ঘিরে তৈরি পোশাকের অসংখ্য চালান আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছানো হয়। রফতানিকারকেরা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার অনেকটা ঝামেলা ছাড়াই তৈরি পোশাক রফতানির পিকআওয়ার পার করছেন তারা। রফতানিও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। যথাসময়ে শিল্পের কাঁচামাল এসে পৌঁছানোর ফলে রফতানি অর্ডার যথাসময়ে সম্পন্ন করা গেছে।
প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পাঁচ হাজারের মত কন্টেইনার ওঠানামা হচ্ছে। সমানতালে চলছে আমদানি খোলা পণ্য খালাস, ডেলিভারি পরিবহনও চলছে দ্রুতগতিতে। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সচল থাকায় পণ্য পরিবহনে কোন সমস্যা নেই। বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত মাদার ভেসেল থেকে লাইটারেজ জাহাজে জ্বালানি তেল, চিনি, ভোজ্যতেল, গম, ডাল, চালসহ ভোগ্যপণ্য দ্রæত খালাস হচ্ছে। সিমেন্ট ক্লিংকার, স্ক্র্যাপসহ শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং পদ্মা সেতুসহ চলমান বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রীও আসছে বন্দর দিয়ে। ছোট জাহাজেই নৌপথে এসব পণ্য পরিবহন করা হচ্ছে। বহির্নোঙ্গর থেকে খালাস করে আনা লাইটার জাহাজ থেকে কর্ণফুলীর ১৬টি ঘাটে সার্বক্ষণিক পণ্য খালাস চলছে। এসব পণ্য গুদামজাত করার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিবহন করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, গত বছর করোনার ধাক্কায় কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং কিছুটা কমে গেলেও এবার সে ধাক্কা সামলে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে বন্দর। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৩ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ২০২০ সালে হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউএস। ২০১৯ সালে হয়েছিল ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউএস। চলতি ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দরে ১১ কোটি ২৬ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিকটন পণ্য ওঠানামা হয়েছে। ২০২০ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৩২ লাখ ৯ হাজার মেট্রিকটন এবং ২০১৯ সালে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিকটন। এ বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাহাজ এসেছে চার হাজার ৫৪টি। ২০২০ সালে আসে তিন হাজার ৭২৮টি এবং ২০১৯ সালে তিন হাজার ৮০৭টি।
বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে বলেন, বন্দরে এখন কোন জাহাজ ভিড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বন্দরের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। আর তাই বছর শেষ হওয়ার আগেই বন্দর ৩১ লাখ কন্টেইনার পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে। কন্টেইনার, কার্গো এবং জাহাজ হ্যান্ডলিং- এই তিনদিকেই সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এবার ১০ থেকে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলেও জানান তিনি।
বিজিএমইএএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর এখন শতভাগ গতিশীল। আমদানি-রফতানি বেড়ে যাওয়ার পরও বন্দর সক্ষমতার সাথে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে এবার তৈরি পোশাক রফতানি ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কাঁচামালের আমদানি এবং রফতানি পণ্য জাহাজিকরণ স্বাভাবিক থাকায় তৈরি পোশাকসহ রফতানিকারকরা যথাসময়ে পণ্য রফতানি করতে পারছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও সুদৃঢ় হবে।
বেসরকারি কন্টেইনার মালিকদের সংগঠন বিকডার সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদকার বলেন, বন্দরের সাথে পাল্লা দিয়ে অফডকের কার্যক্রমেও দারুণ গতি এসেছে। বন্দরের মত অফডকও এখন জটমুক্ত। ৭০ হাজার টিইইউএস ধারণক্ষমতার ১৯টি ডিপোতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কন্টেইনার ছিল ৪৪ হাজার ৮০০ টিইইউএস। এর মধ্যে খালি কন্টেইনার ১৯ হাজার টিইইউএস। রফতানিমুখী কন্টেইনার রয়েছে আট হাজার এবং আমদানি কন্টেইনার সাত হাজার ৮০০ টিইইউএস।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ