পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
র্যাবের সাবেক ডিজি এবং পুলিশের বর্তমান আইজি বেনজীর আহমদসহ র্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৭ জন সিনিয়র অফিসারের বিরুদ্ধে যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তার পূর্বাপর পটভূমি বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সবিস্তার প্রকাশিত হয়নি। সকলেই যে যার লাইন থেকে এই ঘটনা বর্ণনা করছে এবং পার্টিজান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছে। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ স্বচ্ছ ধারণা পাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞাসহ আগে পরে ৪টি ঘটনা ঘটেছে। সেগুলির সবকটি বলা হচ্ছে না।
নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে গত ১০ ডিসেম্বর। তার প্রায় ১৪ মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির সময় রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট, উভয় দলের ১০ জন সিনেটর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কাছে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে র্যাবের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট দাবি জানানো হয়। ওই যৌথপত্রে অভিযোগ করা হয় যে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত র্যাব বিচারবহির্ভূতভাবে ৪০০ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। এই কারণে র্যাবের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানান ওই ১০ জন সিনেটর। তারা ২০২০ সালের আইনের ৭০৩১ অনুচ্ছেদের (গ) উপঅনুচ্ছেদের অধীনে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। পত্রে বলা হয় যে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগেই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে চলেছে। আরো বলা হয় যে, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সুপরিকল্পিতভাবে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। স্থানাভাবে আমরা ওই যৌথপত্রের হুবহু অনুবাদ পেশ করা থেকে বিরত থাকছি। এই যৌথপত্রের উদ্যোক্তা হলেন বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর বব মেন্ডেজ এবং ডেমোক্র্যাট সিনেটর টড ইয়াং। অপর যে ৮ জন সিনেটর ওই যৌথ চিঠিতে সই করেছেন তারা হলেন সিনেটর বেন্ড কার্ডিন (ডেমোক্র্যাট), সিনেটর করি গাডনার (রিপাবলিকান), সিনেটর জিন শাহীন (ডেমোক্র্যাট), সিনেটর মার্কোরুবিও (রিপাবলিকান), সিনেটর ক্রিস মার্ফি (ডেমোক্র্যাট), সিনেটর ক্রিস কুনস (ডেমোক্র্যাট), সিনেটর জেফ মার্কলে (ডেমোক্র্যাট) এবং সিনেটর করি বুকার (ডেমোক্র্যাট)।
৩৩ কোটি মার্কিন নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র ১০০ জন সিনেটর। সে কারণে মার্কিন সিনেট অত্যন্ত ক্ষমতাবান একটি বডি। সেই ১০০ জনের মধ্যে ১০ জনই ইনিসিয়েট করেছিলেন এই নিষেধাজ্ঞার প্রক্রিয়া। কিন্তু তার ১ মাস পর অর্থাৎ নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সুতরাং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেটি করার সময় পাননি সেটি করলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
॥দুই॥
র্যাবের প্রাক্তন মহাপরিচালক এবং পুলিশের বর্তমান আইজি বেনজীর আহমদ এবং র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ছাড়াও আর যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তারা হলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, প্রাক্তন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার, প্রাক্তন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, প্রাক্তন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ আনোয়ার অতিফ খান। বেনজীর আহমদ এবং চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের আমেরিকায় প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ১১ ডিসেম্বরের খবর অনুযায়ী, প্রাক্তন সেনা প্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের মার্কিন ভিসা বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর ‘দৈনিক সমকালের’ অনলাইন সংস্করণের রিপোর্ট মোতাবেক জেনারেল আজিজ আহমদ তার মার্কিন ভিসা বাতিলের খবর অস্বীকার করেছেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে। সেটি হলো, ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ছাড়াও আরও তিনটি দেশের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশ তিনটি হলো চীন, মিয়ানমার এবং উত্তর কোরিয়া। বাংলাদেশকে বাইডেন প্রশাসন ওই তিনটি দেশের সাথে এক বন্ধনীভুক্ত করলো কিনা সেটা বুঝতে আরও একটু সময় লাগবে।
এই নিষেধাজ্ঞার আশু এবং সুদূরপ্রসারী ফলাফল এবং তাৎপর্য কী সেটি নিয়ে বিশ্লেষণ এবং গবেষণা চলছে। তবে যাদের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হলো তারা অতঃপর আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারবেন না। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব অথবা ওই ৭ ব্যক্তির আমেরকিায় প্রবেশ যেমন নিষিদ্ধ হলো, তেমনি আমেরিকায় তাদের সহায়-সম্পত্তি বা টাকা কড়ি যদি কিছু থাকে তাহলে সে সমস্তও বাজেয়াপ্ত হলো। তারা অতঃপর আমেরিকায় বসবাসকারী কোনো গ্রিনকার্ডধারী বা কোনো মার্কিন নাগরিকের সাথে কোনো লেনদেন করতে পারবেন না। তেমনি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও র্যাবের সাথে মার্কিন সরকারের কোনো কার্যকর সম্পর্ক (Working relationship) থাকবে না। তবে ওই ৭ ব্যক্তি ছাড়া র্যাবের অবশিষ্ট সদস্যবর্গের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে এই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। আমেরিকায় যদি ওই ৭ ব্যক্তি বা র্যাবের কোনো সহায়-সম্পত্তি বা টাকা পয়সা থাকে তাহলে সেগুলো হস্তান্তর, অন্যদেশে স্থানান্তর বা উঠিয়ে নেওয়া যাবে না। যে আইনের অধীনে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে সেটির নাম Global Magnitsky আইন। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অর্ডারে স্বাক্ষর করেন। যে নির্বাহী আদেশে এই নিষেধাজ্ঞা জারি হলো সেটির নম্বর হচ্ছে ১৩৮১৮। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা ছাড়াও র্যাবের প্রাক্তন অফিসার লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমদও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবেন।
আমি আগেই বলেছি যে, এই নিষধাজ্ঞা হঠাৎ করে এক দিনে আসেনি। বেশ কয়েক বছর ধরেই রবার্ট কেনেডি মানবাধিকার সংস্থা এবং সিনেটর উপকমিটি এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের একটি কোর কমিটি দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার শুনানি গ্রহণ করে। ওরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে র্যাবের সদস্যদের যোগদান নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে।
॥তিন॥
চিত্রের অপর পিঠে আরেকটি দৃশ্যকল্প দেখা যায়। বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা বার্তায় চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ আশ্চর্য সাধন করেছে (Stood a wonder)। এটি সম্ভব হয়েছে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের ফলে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ আরেকটি আশ্চর্য সাধন করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে (Great leadership) উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে। এছাড়া নজিরবিহীন কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব অসাধারণ।’ তিনি তার বাণী শেষ করেন এই বলে, ‘জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু! চীন-বাংলা বন্ধুত্ব অমর হোক।’ এছাড়া চীনা রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্রোঞ্জের তৈরি একটি আবক্ষ মূর্তি উপহার দেন। মূর্তিটি ১ দশমিক ৯ মিটার লম্বা এবং ৬২ সেন্টিমিটার চওড়া (প্রস্থ)। শেখ হাসিনা বলেন, সারা জীবন বঙ্গবন্ধু চীনের বন্ধু ছিলেন। তিনি চীনের বিশাল সমৃদ্ধি দিব্যচোখে দেখেছিলেন। আজ চীনের অর্থনীতি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম।
॥চার॥
কেন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো? এই প্রশ্ন নিয়ে পত্রপত্রিকায় যত আলোচনা হবে বলে মনে হয়েছিল তত হয় নাই। সরকারের তরফ থেকে অপহরণ, গুম, খুন ইত্যাদি অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নাই। এক শ্রেণির পত্রপত্রিকা বিগত ১২ বছরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বিভিন্ন সময় Enforced disappearances এর যেসব সংবাদ ছাপিয়েছে সেই সব খবর এবং খবরে পরিবেশিত তথ্য ও পরিসংখ্যান পুনরুল্লেখ করছে।
দুই-তিনটি রাজনৈতিক ভাষ্যে দুই তিনজন বুদ্ধিজীবী এবং সাবেক আমলা বলেছেন, মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিৎ হবে না। কারণ ৪টি দেশের ১৫টি সংস্থার বিরুদ্ধে একই তারিখে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দেশ ৪টি হলো চীন, উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে বাদ দিলে অবশিষ্ট তিনটি দেশকে এক বন্ধনীতে যুক্ত করা যায়। তাহলে বাংলাদেশকেও কি সেই ব্র্যাকেট বা বন্ধনীর মধ্যে ফেলা হলো? এই প্রশ্ন অনেকের মনেই উদয় হয়েছে। তাহলে এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে কি রয়েছে ভূ-রাজনীতি ও ভূ-রণকৌশল (Geo politics) and (Geo strategy)?
যদি তাই হয় তাহলে বাংলাদেশ এক কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুখে পড়ে গেল। এই সরকারের সামনে এক বিব্রতকর প্রশ্ন এসে গেল। তারা শ্যাম রাখবে? নাকি কুল রাখবে? আন্তর্জাতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, ৯০-এর দশকে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর Cold war বা শীতল যুদ্ধের অবসান হয়েছিল। ২০১৬ সাল থেকে সেটি আবার শুরু হয়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এটি সুপ্ত ছিল। কিন্তু ২০২০ সাল থেকে এটি প্রকাশ্যে এসেছে। এটি হলো, আমেরিকা বনাম চীন।
আমেরিকার নেতৃত্বাধীন কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দেয়নি বলে আমেরিকা নাকি বাংলাদেশের ওপর প্রসন্ন নয়। আবার ওই দিকে বাংলাদেশ যেন কোয়াডে যোগ না দেয় সে ব্যাপারে চীন বাংলাদেশকে প্রকাশ্যে সতর্ক করে দিয়েছে। কোয়াডে আছে ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। আবার চীনের সাথে আছে মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান।
বাংলাদেশকে এই দুই শিবিরের মধ্যে ব্যালান্স করে চলতে হবে। তবে কাজটি বলা যত সহজ, করা তত সহজ নয়।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।