Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বিজয় দিবসের ভাবনা

আফতাব চৌধুুরী | প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার এপ্রিল ২০১৯ সংখ্যার প্রচ্ছদ ছিল। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তিন চাকার রিকশা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। রিকশায় বসা এক তরুণের হাতে মোবাইল, পায়ের কাছে কম্পিউটার। পরে ওই পত্রিকায়ই কোনো এক ভদ্রলোক লিখেছিলেন, ‘মধ্যযুগীয় যানটিতে যেন এগিয়ে চলেছে আজকের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। আহা! কি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। একদিকে এক বুদ্ধিদীপ্ত ঝলমলে তরুণ- তার চোখে শিক্ষার চশমা, বাঁ হাতে বাঁধা রয়েছে সময়, ডান হাতে মোবাইলে ভুবনীকরণ, কাঁধে ফেলে রাখা ব্যাগে দায়িত্ব, পায়ের কাছে কম্পিউটারে নতুন দুনিয়া, বাঁ হাতের তর্জনীতে এগিয়ে চলার আগ্রহ। অপরদিকে তার বাবার বয়সী রিকশাওয়ালার গামছায় নগ্ন পা দুটিতে শ্রম আর মুখে নিয়তিকে মেনে নেওয়া এক বিষণ্ন হাসি। মোবাইলে কথা বলতে বলতে যুবকটি এগিয়ে চলেছে ‘তিন চাকার রিকশায়। আহঃ প্রযুক্তির কী ভীষণ অগ্রগতি’।

ডিসেম্বর মাস, স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল, এক কথায় ৫০ বছর হয়ে গেল ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার। ‘গরীবি হটাও’, ‘উন্নয়ন কর’ শ্লোগানমুখর দেশের বর্তমান ছবির কথা ভাবতে গিয়ে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকার ওই প্রচ্ছদ এবং তৎসংশ্লিষ্ট বাক্যগুলো। এরই সমর্থন মেলে, যখন আরও এক লেখায় পাই-‘একদিকে হাজার হাজার উচ্চবিত্ত বাংলাদেশির ওজন কমানোর চেষ্টা, অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষের খেতে না পাওয়ার করুণ কাহিনী। গ্রামীণ মানুষগুলোর ঋণের বোঝা এতই যে তারা জমি হারাচ্ছেন, বহির্গমনে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের বাড়ির মহিলা ও অল্পবয়সী মেয়েদের কেউ কেউ অভাবের তাড়নায় অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ নিচ্ছেন আবার কেউ কেউ অসামাজিক কাজ কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। গ্রামে বিয়ে বাড়ির মহল নেই, অন্যদিকে ধনীদের চোখ ধাঁধানো বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে মনে হয় দেশে যেন বিত্তের অভাব নেই। একদিকে তীব্র জলাভাবে দেশের জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশের হাহাকার, অন্যদিকে ধনীদের আমোদ-প্রমোদের জন্য স্বল্প টাকা ব্যয়ে ওয়াটার পার্ক নির্মাণ।’ অন্ততঃ বলা যায়, এ ভাবেই চলছে।

বিজয়-পরবর্তী এ দেশ আসলে যেন দুটো বাংলাদেশের সমন্বয়। এক- ‘আছে, দুই নেই। এ দু’টো বাংলার মধ্যে স্থানিক দূরত্ব কিন্তু বেশি নয়। শহরের ঝকঝকে মার্কেট কমপ্লেক্সের খুব দূরে নেই লোকদের ক্ষণস্থায়ী বসত। আর শহরের দূরে অল্প-কিছুটা পথ গিয়ে যদি পায়ে হেঁটে গ্রাম-গঞ্জ-চা-বাগানে পৌঁছে যান, তবেই পেয়ে যাবেন ‘নেই বাংলাদেশ -এর খোঁজ। অর্থনীতিবিদরাও জানাচ্ছেন, ‘বিজয় পরবর্তী কালে এ দেশে প্রকটভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বৈষম্য। অকল্পনীয়ভাবে এ বৈষম্য বেড়ে চলেছে। খাদ্যদ্রব্যই হোক আর অন্যান্য যা কিছু , দেশের উচ্চবিত্তরা এখন যে পরিমাণ ভোগ-বিলাসের মধ্যে আছে, এর আগে কখনও এমন ছিল না। এমন একটা দেশে এ ঘটনাগুলো ঘটছে, যে দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী অপুষ্টিতে ভোগা শিশু বাস করে। এ দেশেই এখনও পাঁচ বছর বয়সের নিচে অর্ধেক শিশু অপুষ্টি ও অবৃদ্ধিজনিত অসুখে ভোগে, এদের মধ্যে অধিকাংশই আবার মেয়ে।’ এরা আরও জানাচ্ছেন, ৮০ শতাংশ পরিবারের কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। লক্ষ লক্ষ কৃষক ঋণের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকেন আর ঋণভারে জর্জরিত হয়ে মারা যান।

তাহলে স্বদেশ, বিজয়, আর্থিক সংস্কার, উন্নয়ন দীর্ঘ ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে হয়েছেটা কি? পরিকল্পনা ইত্যাদি সব শব্দগুলো একেবারেই অর্থহীন? ব্রিটিশ এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানে তাহলে হয়েছেটা কী? বাধ্যতামূলক শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, সকলের জন্য খাদ্য ও নিরাপত্তা এগুলো কি শুধু সংবিধানকে উৎকৃষ্ট করে তোলার জন্যই ব্যবহার করা হয়েছে? ‘বাংলাদেশ আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ বলে কবি যে বলে গেছেন,তা কি শুধু কাব্যকে সমৃদ্ধ করার জন্যই? এমন অনেক প্রশ্নই আমাদের মনে আসা স্বাভাবিক।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের মত বড় বড় নগরীতে যখন হাঁটি তখন এ প্রশ্নগুলো আমাদের ভাবায়। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, ‘এ দেশটার নাম জানো তোমরা?’ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে কেউ কেউ উত্তরে বলেন নিজে যে জায়গায় বাস করি সেটার নাম? ‘না, না, আমি গোটা দেশের কথা বলছি। এটা তো তোমার গ্রাম, তোমার অঞ্চল। যে দেশটাতে আমরা বাস করি সে দেশটার নাম জানো?’ ‘হ্যাঁ, স্বাধীন বাংলা’। ক’বছর আগের কথা বলছি। ছাতক সুরমা নদীর তীর দিয়ে এক বন্ধুর সাথে পায়চারি করছিলাম, তাকিয়ে দেখি, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ১৭/১৮ বছরের এক যুবক। ছাতক পেপার মিলে বাঁশ সাপ্লাইয়ের কাজ করে সে। অন্যরা, যারা কাছে-পিঠে ছিলেন, বিশেষ করে মহিলারা যাদের বয়স ঠিক কত হবে আন্দাজ করে বলা যায় না, তারা কেউ কেউ হাসেন, অন্য কথায় চলে যান। আবার প্রশ্ন রাখি, ‘সকালে কি খেয়েছ তোমরা?’ কেউ বলেন, ‘না, মুখে কিছুই দিইনি এখনও।’ কী বলেন ওরা? বিস্ময়ে হাতে বাঁধা ঘড়িতে চোখ রেখে আঁতকে উঠি। বেলা প্রায় দুটো। ‘রান্না করনি কিছু?’ ‘না করিনি। কি রাধব? তাই তো খুঁজে মরছি। কচুটা, লতাটা খুঁজব, তারপর লাকড়ি যোগাড় করতে পারলে রান্না হবে। মিল বন্ধ আছে। তলব নেই, কাজ নেই, টাকাও নেই। একবেলা খেতে পারলে দু’বেলার চিন্তা করতে হয়, বলেছিলেন লক্ষ্মী গড়াইত।’ বয়সের প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন, ‘বড় সাহেব এখানে এসেছিলো যখন-তখনই আমার জন্ম হয়।’ তবে বড়সাব কবে কখন এসেছিলেন তা-তার মনে নেই।

সংবিধানে লেখা আছে, ‘যদি মানুষের খাদ্য ও কাজের অধিকার না থাকে তবে তার বাঁচার অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে।’ অর্থহীন হয়েই তাই বেঁচে আছে আধা গ্রাম, গঞ্জ। বন্ধ চা বাগান, বন্ধ পাঠকল। ঘরে ঘরে অনাহার নিত্যসঙ্গী। হাড় জিরজিরে, পেটমোটা শিশুদের মিছিল এখানে সেখানে জটলা বেঁধে বুনো ঝোঁপের ছোট ছোট গাছ থেকে মৌ থাকা ফুলগুলো, ফলগুলো খুঁজে, মুখে দেয়, মারপিট করে আর ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে নতুন দেখা কোনও মানুষের দিকে। তাদের মুখে ঘা, সারা শরীরে পাঁচড়া। দয়াপুর বস্তির মেয়ের বিয়ে হয়েছে লাইনটিলায়। হাতে, কোলে পেটে সর্বমোট পাঁচটি বাচ্চা। এতগুলো বাচ্চার মা ভরপেট খাবার শেষ কবে খেয়েছিল মনে করতে পারে না। পরনের রংচটা ছেঁড়া কাপড়টাই একমাত্র সম্বল। গত বছর ঈদের দিনে এক ধনী বিধবা তাকে এটা দিয়েছিলেন। কোনও বাচ্চার জন্মের সময়ে হাসপাতালে যেতে হয়নি, ঔষুধও পায়নি এক ফোঁটা। ‘কেন, গ্রামে তো ডাক্তার আছেন। দেখান না কেন? ইনজেকশন নেন না কেন?’ প্রশ্নের উত্তরে ওর হয়ে বোন জবাব দেয়, ‘বলে কি, ঔষুধ, ইনজেকশন নিলে জঞ্জাল বেশি। ওর মাওতো (মেয়েটির শাশুড়ি) দশটা বাচ্চার জনম দিল, তখন তো ঔষুধ ইনজেকশন কিছুই নিল না। তাই , বৌটাকে কিছু নিতে দেয় না।’ আসল কারণ জানা গেল আরও পরে। ওরা কেউই এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নয়, কোথাও নাম লিখতে গেলে যদি ধরা পড়ে যায় তাই কোনও সরকারি সেবা নিতে তাদের আপত্তি।

বিজয় পরবর্তী দেশে দারিদ্র দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও বাসস্থান এবং শিক্ষা-এ পাঁচটি ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের বা সরকারের একটা বড় ভূমিকা থাকার কথা ছিল। যে কোনও মতের যে কোনও পথের বিশেষজ্ঞরাই এ ব্যাপারে মোটামুটি একমত। সেটা জানেন বলেই অর্থমন্ত্রীদের প্রতিবছর বাজেট বক্তৃতায় নিয়ম করে এসব বিষয়ে প্রতিশ্রুতি বিতরণ করতে হয়। কিন্তু হিসেবের খাতা খুঁটিয়ে দেখলেই ধরা পড়ে কথা এবং কাজের মধ্যে ফারাক কতটা। জাতীয় বার্ধক্য ভাতা প্রকল্প, জাতীয় পরিবার সহায়তা প্রকল্প ইত্যাদি নানা রকম প্রকল্পের কথা শুনে থাকি আমরা। কিন্তু এ সবের ফলে কারা লাভবান হচ্ছেন আর কারা বঞ্চিত হচ্ছেন তা চোখ কান খোলা রাখলেই বিজ্ঞজনেরা জানতে পারবেন।

আসলে, আমরা এগুলো জেনেও জানতে চাইছি না। কারো কারো জীবনে সুখ এখন উপচে পড়ছে। মোবাইল কানেকশন পাওয়ার লাইন দেখলেই বোঝা যায়। আমাদের হাতে মোবাইল, পায়ে দামী সু, ধারে কাছে বেড়ানোর জন্য নতুন গাড়ি, বাইক অসম্ভব দ্রুত বয়ে চলা সুখী জীবনে ‘বিজয়’ শব্দটি অনেক কিছু এনে দিয়েছে। আর এর বাইরের মানুষের কথা? ভাববেন অন্যরা। মন্ত্রীরা, আমলারা, অর্থনীতিবিদরা, জনপ্রতিনিধিরা। আমরা আমাদের মতো চলব, ওরা ওদের মতো। স্বাধীনতার প্রাপ্তি বোধহয় এটাই!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিজয় দিবসের ভাবনা

১৮ ডিসেম্বর, ২০২১
আরও পড়ুন