Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তলিয়ে যাওয়া শিশুর লাশ উদ্ধার : প্রতিক্ষায় ছালেহ আহমদের পরিবার

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:০০ এএম

চট্টগ্রামের খাল-নালায় মৃত্যুফাঁদ
একের পর এক মৃত্যুতেও নির্বিকার চসিক-সিডিএ
নগরীর চশমা খালে তলিয়ে নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর শিশু মো. কামাল উদ্দিনের (১২) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর শুলকবহরের মির্জা খালে লাশটি ভেসে উঠে। পুত্রের লাশ নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কামাল উদ্দিনের হতভাগ্য বস্তিবাসী পিতা মো. আলী কায়সার। সোমবার দুপুরে ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের উল্টো দিকে ভুমি অফিস লাগোয়া চশমা খালে খেলনা কুড়াতে নেমে আবর্জনায় তলিয়ে যায় কামাল। সেই থেকে পুত্রের খোঁজে আহার নিন্দ্রা ছেড়ে খালের পাড়ে পাড়ে ঘুরছিলেন তিনি। জীবিত না হোক আদরের সন্তানের লাশটি হলেও পেয়েছেন আলী কায়সার।
কিন্তু একই খালে গত ২৫ আগস্ট পা পিছলে পড়ে নিখোঁজ সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমদের (৫০) সন্তানেরা তার লাশটিও পাননি। এখনও পিতার লাশের প্রতীক্ষায় তারা। শিশু কামাল উদ্দিনের বাবার অভিযোগ তার ছেলে সাঁতার জানতো। খালে আবর্জনা না থাকলে সে সাঁতরে উঠে আসতে পারতো। যেমন উঠে এসেছে তার সাথে তলিয়ে যাওয়া রাকিব। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন খালে আবর্জনা পরিষ্কার না করায় তার ছেলে সেখানে আটকা পড়ে।
তবে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা এমন অভিযোগ মানতে নারাজ। নগরীতে উন্মুুুক্ত খাল, নালা-নর্দমায় পড়ে একের পর এক মৃত্যু আর হাত-পা ভেঙে আহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও এর দায় কেউ নিচ্ছে না। এ ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ। এ দুই সংস্থা ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে। মহানগরীর প্রধান প্রধান সড়কের পাশেসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার স্পটে উন্মুুক্ত খাল, নালা মৃত্যুফাঁদ হয়ে আছে। এসব নালায় পড়ে যে কোন সময় ঘটতে পারে প্রাণহানির ঘটনা। উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়িতে রাস্তা, ফুটপাত, খাল, নালা, নর্দমা এখন একাকার। পথ চলতে কখন কে পড়ে যাচ্ছেন মৃত্যুক‚পে তা নিয়ে শঙ্কিত সবাই।
নগরীতে সিডিএর উদ্যোগে পানিবদ্ধতা নিরসনে চলছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন। এই প্রকল্পের অংশ হিসাবে নগরীর প্রায় সবকটি বড় বড় খাল ও নালা সংস্কার এবং সম্প্রসারণ চলছে। এসব খাল, নালার বেশির ভাগ উন্মুুক্ত। এমনকি জনবহুল এলাকায়ও মৃত্যুফাঁদ হয়ে আছে অনেক খাল, নালা। নেই কোন সতর্কতামূলক নির্দেশাও। বাকি খাল নালার বেশিরভাগের উপর নেই কোন সø্যাব। একটু অসতর্ক হলেই পা ফসকে নালা, নর্দমায় পড়ে যাওয়ার শঙ্কা নিয়ে পথ চলছে নগরবাসী। কোথাও কোথাও খাল, নালা আবর্জনায় ভর্তি হয়ে রীতিমত কাঁচা সড়কের রূপ ধারণ করেছে।
গত সোমবার দুপুরে নগরীর ষোলশহরে চশমা খালে আবর্জনার উপর দিয়ে হেঁটে প্লাস্টিকের বোতল ও খেলনা খুঁজতে নেমে পড়ে শিশু কামাল উদ্দিন ও তার বন্ধু রাকিব। খালের মাঝামাঝি যেতেই তারা তলিয়ে যায়। ওইদিন সকাল থেকে বৃষ্টি হওয়ায় খালে স্রোত ছিলো। কিন্তু আবর্জনা ভরা খালে স্রোত দেখা যাচ্ছিল না। তলিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রাকিব স্রোতের তোড়ে খালের পাড়ে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে উপরে উঠে আসে। আর কামাল উদ্দিন চাপা পড়ে আবর্জনার নিচে। খাল থেকে উঠে রাকিব ছুটে গিয়ে কামালের পিতাকে খবর দেয়। খবর পেয়ে আলী কায়সার একাই ছেলেকে খুঁজতে বের হন। আবর্জনার ভেতরে ছেলেকে খুঁজতে থাকেন। স্থানীয়দের সাহায্য চাইলে কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি। পরদিন মঙ্গলবার বিকেলে শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর থেকে শুরু হয় তল্লাশি অভিযান।
গতকাল টানা তৃতীয় দিনের মতো তল্লাশি শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। প্রথম দুই দিন চশমা খাল ও এর সঙ্গে যুক্ত নালায় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। খাল ও নালার সঙ্গে যুক্ত মির্জা খালও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনে ফায়ার সার্ভিস। দুপুরের আগে মির্জা খালে একটি লাশ ভেসে উঠে। স্থানীয়রা খবর দেয় ফায়াস সার্ভিসকে। তখন উদ্ধারকর্মীরা সেখান থেকে লাশটি উদ্ধার করেন। পরে আলী কায়সার তার পুত্র কামাল উদ্দিনের লাশটি শনাক্ত করেন। বলা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারীবস্তু পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। সন্তানের লাশের উপর আছড়ে পড়ে আহাজারি করছিলেন আলী কায়সার। আর বলছিলেন আমার মত আর কাউকে যেন এভাবে সন্তান হারাতে না হয়। নগরবাসীরও প্রশ্ন এমন মৃত্যু আর কত? কতজনের মৃত্যুর পর টনক নড়বে সংশ্লিষ্টদের।
গত ২৫ আগস্ট টানা বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতার সময় চশমা খালের মুরাদপুর এলাকায় তলিয়ে গিয়েছিলেন সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমদ। এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শিশু কামাল উদ্দিনের লাশ উদ্ধারের খবরে ছালেহ আহমদের পরিবারে যেন নতুন করে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার সন্তানেরা পিতার কঙ্কালটি হলেও উদ্ধার করার আকুতি জানান। ছালেহ আহমদ তলিয়ে যাওয়ার আগে গত ৩০ জুন মেয়র গলিতে একই খালে পড়ে যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা। তাতে স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়ে চালকসহ দুজন মারা যান।
এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদে খোলা নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া (১৯)। এ ছাত্রীর নির্মম মৃত্যুর ঘটনা দেশের উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। তার পরিবারকে কেন ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে গত এক বছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সাদিয়ার মতো কতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে দুই মাসের মধ্যে এ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গত রোববার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অনীক আর হক।
নালায় পড়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী এবং সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ একে অপরকে দায়ী করে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয় পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে সিডিএ খাল, নালার সø্যাব সরিয়ে নিয়েছে। এইসব মৃত্যুর দায় তাদের। আবার সিডিএর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় খাল, নালায় কোন সø্যাব নেই। এর দায় সিটি কর্পোরেশন এড়াতে পারে না।
মানুষের নির্মম মৃত্যু নিয়ে দুটি সংস্থার এমন মুখোমুখী অবস্থানের প্রেক্ষাপটে দায় নির্ধারণ করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এ কমিটি খাল, নালায় পড়ে মৃত্যুর জন্য দুই সংস্থাকে দায়ী করে গত ১ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেন। কমিটির প্রতিবেদন দেয়ার পরও খাল ও নালা- নর্দমায় পড়ে মৃত্যু প্রতিরোধে দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ