চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইলম হলো মানবজাতির প্রতি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং মহা নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে বর্ণনা শিক্ষা দিয়েছেন’। (সুরা আর রাহমান : আয়াত: ০৪)। মানবজাতির আশরাফুল মাখলুকাত খ্যাতির পিছনেই মূলত: ইলমের প্রধান ভুমিকা রয়েছে। মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব, অন্য সকল প্রানীর উপর কর্তৃত্ব, বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব এ সকল কেবল আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ অনুগ্রহ ‘জ্ঞান’ তথা ‘ইলমের’ মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা কেবলমাত্র মানবজাতিকে ‘যুল আকল’ তথা বিবেক সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতির বিবেক তখনই কল্যাণমূখী বিবেচিত হবে, যখন সেই আক্ল তথা বিবেক নামক মহা নেয়ামত ইলমের আলোয় আলোকিত হবে।
আশরাফুল মাখলুকাত খ্যাত মানবজাতির কতিপয় সদস্যের ‘বিবেক’ থাকা সত্ত্বে¡ও তারা বাস্তবিক ক্ষেত্রে মানবিক আচরণের বদলে পশুসুলভ আচরণ করে বসে। এর একমাত্র কারণ হলো তাদের ‘বিবেক’ নামক শ্রেষ্ঠ সম্পদটি ইলমের আলোয় আলোকিত হয়নি। এ কারনেই তারা বিবেক থাকা সত্বেও বিবেকহীন কাজ করে বসে। এ জন্য দেখা যায় যাদেরকে আল্লাহতায়ালা ইলম দান করেছেন তারা বিবেকহীন কাজ থেকে দুরে থেকে মানবতার অশেষ কল্যাণে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখেন, তারা ইলম শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানুষকে পশুত্বের স্তর থেকে মানবতার স্তরে পৌঁছে দেন। এমনকি তারা অন্যান্য মাখলুকাতের প্রতিও সদয় আচরণ করেন।
তালেবে ইলমের পরিচয় ও মর্যাদা : তালেবে ইলম বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো, যে সকল ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য রাসুল (সা.) এর বাতানো তরিকায় আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান আনুসন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখে এবং অর্জিত ইলম অনুযায়ী সর্বদা আমলে সচেষ্ট থাকে। আমরা সাধারণত তালেবে ইলমগণকে ‘আলেম’ হিসেবেই জানি। মহান আল্লাহ তায়ালা ‘তালেবে ইলম’ এর মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘যারা বিশ্বাসী এবং যাদেরকে ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাদের মর্যাদা অনেক উঁচু করে দেন’। (সুরা মুজাদালা : আয়াত : ১১)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘রাঈসুল মুফাস্সিরীন’ হযরত আবদুল্লাহ উবনে আব্বাস (রা.) বলেন- ‘সাধারণ মুমিনের মর্যাদা অপেক্ষা জ্ঞানী মুমিনের মর্যাদা সাতশত স্তর বেশী হবে এবং প্রত্যেক দু স্তরের দুরত্ব হবে পাঁচশ বছরের সমান।’
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন, ‘হে নবী আপনি বলে দিন যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে’? (সুরা আয যুমার: আয়াত: ০৯)। তিনি আরো বলেন, ‘বান্দাদের মধ্যে একমাত্র আলেমরাই আল্লাহ ভয় করে’। (সুরা ফাতির : আয়াত: ২৮)। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা ইলম তলবকারী আলেমদেরকে ‘ঊতুল ইলম’ এবং ‘আহলুয যিক্র’ আভিধায় আভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,- ‘বরং এ গুলো কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত, যা জ্ঞান প্রাপ্তদের বক্ষে গচ্ছিত’। (সুরা আল আনকাবুত: আয়াত: ৪৯)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘অতএব তোমরা যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তোমরা সে সম্পর্কে না জান’। (সুরা আন নাহল: আয়াত: ৪৩)।
রাসুল (সা.) তালেবে ইলমগণের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে অসংখ্য হাদিস বর্ণনা করেন। তিনি ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যার কল্যান চান তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করেন এবং তার অন্তরে সৎপথ ইলহাম করেন। (আল ইলম আবি খাইছামা : হাদিস: ৫৭)।
তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামকে উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান না। বরং তারা রেখে গেছেন কেবল ইলম। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’। (সুনানে আবি দাউদ: হাদিস: ৩৬৪১; জা’মে তিরমিযি: হাদিস: ২৬৮২)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘আলেম ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব্য আবেদ ব্যক্তির উপর তেমনি যেমন চতুর্দশী চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব তারকারাজির উপর হয়ে থাকে। (সুনানে আবি দাউদ: হাদিস : ৩৬৪১)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন শ্রেনীর লোক শুপারিশ করবে, নবীগণ অতঃপর আলেমগণ অতঃপর শহীদগণ। (সুনানে ইবনে মাজাহ: হাদিস: ৪৯৯২)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম অনুুসনন্ধান করে চলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে চালাবেন। (সুনানে আবি দাউদ: হাদিস: ৩৬৪১)।
প্রখ্যাত সাহাবী উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নাই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২১৪৩)। আনাস ইবনু মালিক (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছও।’ (মুসনাদু আবী ইআ’লা: ২/২৬০)।
হযরত সাফওয়ান ইবনে আস্সাল রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম। তখন তিনি মসজিদে বসে ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি এসেছি ইলম শিক্ষা করার জন্য। তিনি বললেন, তালেবে ইলমকে মারহাবা। নিশ্চয় তালেবে ইলমকে ফিরিশতাগণ বেষ্টন করে রাখে এবং তাঁদের ডানা দিয়ে তাকে ছাঁয়া দিতে থাকে। অতঃপর তাঁরা সারিবদ্ধভাবে প্রথম আসমান পর্যন্ত মিলে মিলে দাঁড়িয়ে যায়। এসব কিছু তাঁরা সে যা অন্বেষণ করছে তার ভালবাসায় করে। (আখলাকুল উলামা, আর্জুরী ১/৩৭; তবারানী কাবীর, হাদীস ৭৩৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫৫০)।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু জর রা.-কে সম্বোধন করে বলেছেন, হে আবু জর, কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা করা তোমার জন্য একশ রাকাত নফল নামায পড়ার চেয়েও উত্তম। ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা তোমার জন্য এক হাজার রাকাত নফল নামায পড়ার চেয়েও উত্তম। চাই এর উপর আমল করা হোক বা না হোক। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২১৯)।
তালেবে ইলমগণের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন মনীষীগণের গুরুত্বপূর্ণ উক্তি : ১. আলী (রা.) বলেন - ‘আলেম ব্যক্তি রোযাদার, এবাদাতকারী ও জিহাদকারী অপেক্ষা উত্তম। আলেম ব্যক্তির মৃত্যু হলে ইসলামে যে শুণ্যতা দেখা দেয়, যা তার উত্তরসুরী ছাড়া কেউ পূরণ করতে পারেনা’।
২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন - ‘হে লোক সকল ইলম অর্জন কর ইলমকে তুলে নেয়ার পূর্বে। ইলমকে তুলে নেবার অর্থ আলেমদের মৃত্যু বরণ করা। আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ- যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয়েছে, তারা আলেম লোকদরকে মাহাত্ম্য দেখে আকাঙ্খা করবে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আলেম অবস্থায় পুনরুত্থিত করলেই ভালো হত। তিনি আরো বলেন, কেউ আলেম হয়ে জন্ম গ্রহণ করে না বরং অুনুসন্ধান (তলব) ও অনুশীলনের (আমল) মাধ্যমেই ইলম অর্জিত হয়।
৩. আবুল আসওয়াদ (রঃ) বলেন - ‘ইলমের চেয়ে বেশী ইজ্জতের কোন বিষয় নেই। বাদশাহ জনগণের শাসক হয়ে থাকে আর আলেমরা (জ্ঞানীরা) বাদশাহের শাসক হয়’। ৪. হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন, “আলেমগণের লেখার কালি এবং শহীদগনের রক্তের ওজন করা হলে আলেমের কালির ওজন বেশি হবে”। তিনি আরো বলেন -“আলেম সম্প্রদায় না থাকলে মানুুষ চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় হয়ে যেত। অর্থ্যাৎ আলেমগণ ইলম শিক্ষাদানের মাধ্যমে মানুষকে পশুত্বের স্তর থেকে মানবতার স্তরে পৌঁছে দেন। ৫. জনৈক মনীষী বলেন - আলেমগণ কালের চেরাগ তুল্য স্ব স্ব সময়ে প্রত্যেকেই উজ্জল বাতি বিশেষ সমসাময়িক তাদের কাছ থেকে আলো আহরণ করে থাকে।
তালেবে ইলমের করণীয় বিষয়াবলী : ইলম আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ (ইলম) দান করেন।’ কাজেই ইলম তলবের সময় প্রত্যেক তালেবকে করনীয় বিষয়াবলী যথাযথ পালন করতে হবে। করনীয় বিষয় হলো- ক. নিয়্যাত বিশুদ্ধ করা ঃ ইলম তলবের জন্য নিয়্যাতকে বিশুদ্ধ করা জরুরী।
এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সকল কাজ নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল, ব্যক্তি তা পায় যা সে নিয়্যাত করে। নিয়্যাতের মধ্যকার বিশুদ্ধতা তথা ‘ইখলাস’ হলো আল্লাহ এবং তার বান্দার মধ্যকার এমন এক নিবিড় সম্পর্ক যার নাগাল শয়তান এমনকি ফেরেশতাগন পর্যন্ত পায় না। কাজেই প্রত্যেক তালেবকে সর্বপ্রথম নিয়্যাত বিশুদ্ধ করতে হবে। খ. আল্লাহর উপর ভরসা করা : ইলম আল্লাহ পক্ষ থেকে প্রদত্ত মহা নেয়ামত। কাজেই তা অর্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর ভরসা করা অতীব জরুরী। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহর তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক: আয়াত:০৩)।
গ. আশাবাদী হওয়া : ইলম অর্জনের সময় বেশ আশাবাদী হওয়া। কেননা যারা নিরাশার দোলাচলে ঘুরপাক খায় তারা কিছুই অর্জন করতে পারেনা। আশাবাদ কোন কিছু অর্জনে ব্যক্তিকে চরম ভাবে উৎসাহিত করে। আল্লাহ পাক আশাবাদ অবলম্বন সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না’।
(সুরা আয যুমার: আয়াত:৫৩)। কাজেই প্রত্যেক তালেবকে ইলম তলবের সময় আশাবাদী হতে হবে। কেননা ইলমও আল্লাহর রহমত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।